নিজস্ব প্রতিবেদক: অগ্নি স্নানে ধরাকে সুচি করতে আগে থেকে প্রস্তুত ছিলেন সূয্যি মামা। মাথার ওপর গনগনে সূর্য, এই তাপদাহে মহাসমারহে হয়েছে বর্ষবরণে আনন্দ শোভাযাত্রার পথ পরিক্রমা কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্রও ভাটা পড়েনি উৎসবের। বরং এ উৎসব আরো বর্ণিল হয়েছে শোভাযাত্রার অগ্রদূত মাহবুব জামাল শামীমের শোভাযাত্রায় অংশ্রহণে। বাঁশি, কাসি, খোল, মন্দিরার তালে পুতুল, পাহাড়, নদী, কুমির, বাঘ, বানর, পাখিসহ নানা উপকরণে মাতোয়ারা ছিল কালেক্টরেট চত্বর।
জেলা প্রশাসনের আয়োজনে আনন্দ শোভাযাত্রার আগে অনুষ্ঠান মঞ্চে হয় সংক্ষিপ্ত পরিসরে একটি অনুষ্ঠান। এতে ‘জাতীয় সংগীত’ ও ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গান গেয়ে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়। এ সময় নববর্ষের শোভাযাত্রার উদ্যোক্তা ভাস্কর মাহবুব জামাল শামীমকে সংবর্ধনা দেয়া হয় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে । জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম ভাস্কর মাহবুব জামাল শামীমের হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট ও পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক তুলে দেন। যশোরের পুলিশ সুপার রওনক জাহান, বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন, জেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক গোলাম রসুলসহ বীর মুক্তিযোদ্ধা, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
পরে জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম বর্ষবরণে আনন্দ শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন। শোভাযাত্রাটি শহরে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে একই স্থানে গিয়ে শেষ হয়।
মুলত সকাল ১০টার পর থেকেই জেলার প্রায় সব সংগঠন কার্যালয়ে ছিল মিষ্টি মুখের আয়োজন। কোনো কোনো সংগঠনে আবার পান্তা ভাতে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়েছে।
ভোর হতে না হতেই এই জনপদে শুরু হয় নতুন বর্ষকে বরণ করে নিতে আনন্দ উৎসব। ছোটবড় অন্তত ৩০টি সংগঠনের উদ্যোগে এবারের বর্ষবরণের মহা আনন্দ অনুষ্ঠান।
উদীচী : দীর্ঘ ৪৮ বছরের ধারাবাহিকতায় পৌর উদ্যানে বর্ষবরণ উৎসবে মাতে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। দিনব্যাপী তাদের অনুষ্ঠানমালা উপভোগ করেছে দশসহস্রধিক দর্শক শ্রোতা। প্রথম পর্বের ৬ টা ৩১ মিনিট থেকে সকাল দশটা পর্যন্ত এবং বৈকালিক অনুষ্ঠান বিকেল ৪ টা ৩১ থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। তিন শতাধিক ছেলে মেয়ে ও শিক্ষার্থীর অংশ গ্রহণে এই অনুষ্ঠানে ছিল সংগীত, নৃত্য ও আবৃত্তি। গোপালগঞ্জ উদীচী থেকে আমন্ত্রিত শিল্পীরা বৈকালিক অনুষ্ঠানে পরিবেশন করে গীতিনাট্য ‘নকশি কাঁথার মাঠ’। এই আযোজন থেকে এবার সংগঠনটির প্রাক্তন সভাপতি সোমেস মুখার্জিকে প্রদান করা হয় ডা. কাজী রবিউল হক পদক । স্থানীয় সকারের উপপরিচালক রফিকুল হাসান প্রধান অতিথি হিসেবে এই পদক তুলে দেন। সংগঠনের সভাপতি আমিনুর রহমান হিরুর সভাপতিত্বে এ সময় শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন উদীচীর উপদেষ্টা ও দৈনিক কল্যাণ সম্পাদক বীরমুক্তিযোদ্ধা একরাম উদ দ্দৌলাহ্, ইলাহদাদ খান, ইকরামুল হক ইল্টু, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান খান বিপ্লব প্রমুখ।
সুরবিতান সঙ্গীত একাডেমী : দেশের প্রাচীনতম সাংস্কৃতিক সংগঠন সুরবিতান একাডেমির প্রভাতী অনুষ্ঠান টাউন হল ময়দানের শতাব্দি বটবৃক্ষ পাদদেশে সকাল সাড়ে ৬ টায় অনুষ্ঠিত হয়। দুই শতাধিক শিক্ষার্থী ছাত্র-ছাত্রীর পরিবেশিত অনুষ্ঠানের ডালিতে ছিল হারানো দিনের গান, নজরুল, রবীন্দ্রনাথসহ পাঁচ গীতি কবির গান, নৃত্য ও আবৃত্তি। এছাড়া সংগঠন কার্যালয়ে ছিল মিষ্টিমুখের আয়োজন।
বিবর্তন ও সুরধুনী : সুপ্রতিষ্ঠিত নাট্য সংগঠন বিবর্তন ও সুরধুনী সংগীত নিকেতন যৌথভাবেই বর্ষবরণের অনুষ্ঠান করে নবকিশলয় স্কুল প্রাঙ্গণে। ছিল দিনব্যাপী অনুষ্ঠান। প্রভাতী অনুষ্ঠান ৬ টা ১ মিনিট থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত এবং বৈকালিক অনুষ্ঠান ৪ টা ৪৫ মিনিট থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। সংগীত আবৃত্তি নৃত্যর পাশাপাশি পরিবেশিত হয় নাটক। প্রভাতী অনুষ্ঠানে শিশুদের নাটক কাজী নজরুল ইসলামের ‘পুতুলের বিয়ে’ এবং বৈকালিক অনুষ্ঠানে বড়দের নাটক বাদল সরকারের ‘মনের আয়না’ সকলকে দিয়েছে আনন্দ। এছাড়াও সকাল ১০টা থেকে সংগঠন দুটির কার্যালয়ে ছিল মিষ্টি মুখের আয়োজন ।
পুনশ্চ যশোর : মুসলিম একাডেমী মাঠে সকাল সাড়ে ছয়টায় এবং বিকাল সাড়ে ৪ টায় দুই পর্বের অনুষ্ঠানে ছিল সংগীত নৃত্য ও আবৃত্তি। দুই শতাধিক ছেলে মেয়ে অংশ নেয় এই অনুষ্ঠানে। এই উৎসব আয়োজনের মাঝে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রয়াত অধ্যাপক সুকুমার দাসের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। বিপুল সংখ্যক দর্শক উপভোগ করে পুনশ্চর অনুষ্ঠান। ছোট ও বড়দের পরিবেশনা সকলকে মুগ্ধ করে।
যশোর সাহিত্য পরিষদ : জেলা পরিষদ সংলগ্ন কবি সাহিত্যিকদের মহামিলন কেন্দ্র সাহিত্য পরিষদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান সকাল সাড়ে ১০ টায় অনুষ্ঠিত হয়। খই, মুড়ি, বাতাসা, গজা-কদমা দিয়ে আপ্যায়ন জানানোর পাশাপাশি কার্যালয়ের নিজস্ব মঞ্চে পরিবেশিত হয় আবৃত্তি ও সঙ্গীত। জেলার বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক আর বাচিক শিল্পিদের উপস্থিতিতে পরিষদ কার্যালয় লেখিয়েদের মহামিলন মেলায় পরিনত হয়। সংগঠনের সভাপতি অধ্যক্ষ শাহিন ইকবাল ও সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান সকলকে স্বাগত জানান।
ইনস্টিটিউট নাট্যকলা সংসদ : ঐতিহ্যমন্ডিত এবং প্রাচীনতম নাট্য সংগঠন ইনস্টিটিউট নাট্যকলা সংসদের আয়োজনে বর্ষবরণ উৎসবে ছিল পান্তা উৎসব। সকাল ন’টা থেকেই কার্যালয় প্রাঙ্গণে এই আয়োজনে নাট্য কর্মীসহ সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি ছিল প্রাণবন্ত।
পূজা উদযাপন পরিষদ : উৎসবমুখর পরিবেশে যশোরে বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ উদযাপন করেছে পূজা উদযাপন পরিষদ। পহেলা বৈশাখের সকালে লালদিঘীর পাড়ে হরিসভা মন্দির সংলগ্ন কার্যালয়ে আয়োজিত এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় সংগঠনটি।
উৎসবের মূল আকর্ষণ ছিল মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বলন। সকালে শুভ সূচনা হয় পবিত্র মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে। যশোর পূজা উদযাপন পরিষদের নেতৃবৃন্দ, ধর্মীয় গুরু এবং সনাতন ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এসময় উপস্থিত ছিলেন।
চাঁদেরহাট যশোর : শিশু কিশোরদের সংগঠন চাঁদেরহাট এর আয়োজনে বিকেলে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জেলা পরিষদ চত্ত্বরে বিশাল মঞ্চে অনুষ্ঠানে অংশ নেয় শতাধিক ছেলে মেয়ে। বিকেল থেকে রাত ৮ টা ১৫ পর্যন্ত এই অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন বিপুল সংখ্যক দর্শক। স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সভাপতি ফারাজী আহমেদ সাঈদ বুলবুল।
নৃত্য বিতান : নৃত্য বিতান যশোরের আয়োজনে সকাল ৯ টা থেকে সংগঠন কার্যালয়ে ছিল মিষ্টিমুখের আয়োজন। বর্ষবরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ২রা বৈশাখের বিকেলে টাউন হল ময়দানের শতাব্দি বটবৃক্ষ তলে আয়োজন করে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের।
যশোর সংস্কৃতিকেন্দ্র : বিকাল চারটায় ঈদগাহ ময়দানে যশোর সংস্কৃতি কেন্দ্রের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। স্থানীয় সরকারে উপপরিচালক রফিকুল হাসান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখন এবং বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচালার অফিসার জসিম উদ্দিন।
এতে অংশ নেয় যশোর সাংস্কৃতিক সংসদ, জীবন তরী সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংসদ, মুন্সি মেহেরুল্লা সাংস্কৃতিক সংসদ, সূর্যোদয় শিল্পীগোষ্ঠী, নজরুল সাহিত্য পরিষদ, যশোর থিয়েটার, তরঙ্গ শিল্পীগোষ্ঠী, ফুলকুড়ি আসর, রেনেসাঁ শিল্পীগোষ্ঠী, প্রতিফলন শিল্পীগোষ্ঠী ও তারার মেলা শিল্পীগোষ্ঠী।
জিয়া স্মৃতি পরিষদ : লালদিঘীর পাড়ে আলী রেজা রাজু মঞ্চে জিয়া স্মৃতি পরিষদের আয়োজনে পহেলা বৈশাখের সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় বাউল সঙ্গীতের অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের ফাকে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত।
সাংবাদিক ইউনিয়ন,যশোর: সাংবাদিক ইউনিয়ন যশোরের উদ্যোগে সন্ধ্যায় প্রেসক্লাব যশোর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মিষ্টি মুখের। জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম, বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
প্রাচ্যসংঘ : বর্তমান সময়ের অতি পরিচিত সংগঠন প্রাচ্য সংঘ যশোরের আয়োজনে বিকেল ৫টায় বর্ষবরণ উৎসব অনুষ্ঠিত হয় নিজস্ব মিলনায়তনে। অনুষ্ঠানে ছিল আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মিষ্টিমুখ। সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দের সাথে কবি সাহিত্যিকরা দিনব্যাপী প্রাচ্যসংঘ আঙ্গিনায় মিলিত হয়।
এছাড়াও সাংস্কৃতিক সংগঠন স্পন্দন, ব্যঞ্জন থিয়েটার, তির্যক, থিয়েটার ক্যানভাস, সপ্তসুর, বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদ, অগ্রিবীণা , সনাতন ধর্মসংঘসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের আয়োজনে পালিত হয় বর্ষবরণ উৎসব।