নিজস্ব প্রতিবেদক : আজ ৬ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনেই যশোর জেলা পাক হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়েছিল। যশোরেই প্রথম উড়েছিল বিজয়ী বাংলাদেশের রক্ত সুর্য খচিত গাঢ় সবুজ পতাকা। এদিন বিকেলের আগেই মুক্তিসেনাদের সহায়তায় ভারতীয় মিত্রবাহিনী পৌঁছে যায় যশোর ক্যান্টনমেন্টে। কিন্তু ক্যান্টনমেন্ট তখন খালি। পাকসেনারা তার আগেই ক্যান্টনমেন্ট ছেড়েছে চলে গেছে। মুক্তিসেনারা দেখতে পায় খাবার টেবিলে প্লেটে খাবার। পড়ে আছে ভাত তরকারি। অর্থাৎ জীবন বাঁচাতে খাবার ফেলেই স্থান ত্যাগ করে নিরাপদ সন্ধানে পাকসেনাদের পলায়ন ঘটে।
এই দিনেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে ভারত। গড়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ড।
যুদ্ধ চলাকালীন বৃহত্তর যশোরের মুজিব বাহিনীর উপপ্রধান রবিউল আলম বলেন, ৭১ সালের ৩ মার্চ যশোর কালেক্টরেটের সামনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে যশোরবাসী শপথ নেয় স্বাধীনতা যুদ্ধের। শহরের রাজপথে বের হয় জঙ্গি মিছিল। এই মিছিলে গুলি চললে শহিদ হন চারুবালা ধর। স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনিই যশোরের প্রথম শহিদ। এরপর থেকেই যশোরে সংগঠিত হতে থাকে প্রতিরোধ। নেতৃত্ব দেয় সংগ্রাম পরিষদ। সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতে থাকে ছাত্র, যুবক ও মহিলাদের। ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী তদানীন্তন জাতীয় সংসদ সদস্য জননেতা মশিউর রহমানকে তার বাসভবন থেকে ধরে যশোর সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে নৃশংসভাবে খুন করে। ২৯ শে মার্চ পাক হানাদার বাহিনী যশোর ছেড়ে সেনানিবাসে চলে যায়। ৩১ মার্চ নড়াইল থেকে হাজার হাজার লোকের এক বিশাল মিছিল আসে। শহরবাসীর সাহায্যে সশস্ত্র মিছিলটি হামলা চালায় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে। মুক্তি পায় সব রাজবন্দী। এর আগে ৩০ মার্চ যশোর সেনানিবাসের বাঙালি সৈনিকেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে। পাকবাহিনীর সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধে লেফটেন্যান্ট আনোয়ারসহ অনেকেই এখানে শহীদ হন।
রবিউল আলম জানান, জুলাই মাস থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের গতিধারা পাল্টে যায়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা যশোর শহর ও অন্যান্য এলাকায় পাকবাহিনীর অবস্থানগুলোতে প্রচণ্ড আক্রমণ চালাতে থাকে। যশোর মুক্তিযুদ্ধের ৮নম্বর রণাঙ্গন। কমান্ডার ছিলেন তদানীন্তন মেজর মঞ্জুর। অন্যদিকে, পাকবাহিনী মোতায়েন ছিল ১০৭ নম্বর ব্রিগেডে। এর কমান্ডার ছিলেন বিগ্রেডিয়ার হায়াত খান। যশোর সেনানিবাস থেকে শত্রুবাহিনী ৬টি জেলা নিয়ন্ত্রণ করত।
২০ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যশোর সেনানিবাস দখলে অভিযান শুরু করে। পাক বাহিনীর পশ্চিমাঞ্চালের শক্তিশালি ঘাঁটি চৌগাছা ঘিরে ফেলে সম্মিলিত বাহিনী। মিত্রবাহিনীর গোলার আওতায় আসে যশোর সেনানিবাস। ২২ নভেম্বর রাতে পতন হয় চৌগাছার। হানাদার বাহিনী সলুয়া বাজারে তৈরি করে অগ্রবর্তী ঘাঁটি। এসময় যশোর সেনানিবাসের তিন দিকেই মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসে। এ অঞ্চলের পাকবাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান প্রাণ ভয়ে তার অফিস স্থানান্তর করেন খুলনায়। প্রতিরোধ যুদ্ধের শেষ অভিযান শুরু হয় ৫ ও ৬ ডিসেম্বর। যুদ্ধে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী পালিয়ে যায় খুলনার দিকে।
৬ ডিসেম্বর দুপুরের পর থেকেই মুক্তি বাহিনী যশোর শহরে প্রবেশ করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত মুক্ত শহরে ওড়ে স্বাধীন দেশের পতাকা। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বুকে লালন করে চোখের জল মোছেন চৌগাছার মশ্মিমপুরের আইয়ুব আলীর মা। বালক আইয়ুব আলী একমাত্র অপরাধ সে আওয়াজ তুলে ছিল ‘জয় বাংলা’। এই অপরাধে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এমনি অনেক ত্যাগের ও বেদনার কাহিনী ছড়িয়ে আছে যশোর জেলার সর্বত্র।
পাক হানাদারদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন আইনজীবীদের মধ্যে মশিউর রহমান সুশীল কুমার রায়, সৈয়দ আমির আলী ও আব্দুর রসিদ খান, বাঘারপাড়া থানা আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আব্দুল কাদের, আবু তালেব, শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ সুলতান অধ্যাপক নবীন চন্দ্র, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নারায়ন সাহা, সমাজ সেবক সুধীর ঘোষ, নাট্য অভিনেতা অমল সোম, চিকিৎসক ওবায়দুল হকসহ অসংখ্য বাঙালী সন্তান।
এদিকে দিবসটি পালন উপলক্ষে ৬ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৩ টায় টাউনহল ময়দান থেকে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে বের হবে গণর?্যালি ।
র্যালিটি শহর প্রদক্ষিণ করে একই স্থানে গিয়ে শেষ হবে। র্যালি শুরুর আগে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যশোরের শিল্পীরা পরিবেশন করবে জাতীয় সঙ্গীত ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গীত।