বাংলাদেশের স্মরণীয় সাফল্য

ইংলিশদের বাংলাওয়াশ

এখন সময়: শনিবার, ২০ এপ্রিল , ২০২৪, ০৫:০৭:৫৯ পিএম

 

সুলতান মাহমুদ রিপন : ঘরের মাঠে বাংলাদেশই সেরা। সেটা আবারও প্রমাণ করল টাইগাররা। যদিও স্বাগতিকদের ইনিংসের শেষে দিকে কাঙ্ক্ষিত ঝড় তুলতে পারলেন না লিটন কুমার দাস। তবুও তার ফিফটিতে চ্যালেঞ্জিং পুঁজি পেল বাংলাদেশ। আর লক্ষ্য তাড়ায় ডেভিড মালান ও অধিনায়ক জস বাটলারের কাঁধে চড়ে কক্ষপথে ছিল ইংল্যান্ড। এরপর টি২০ ক্যারিয়ারের শততম উইকেট নিয়ে মুস্তাফিজুর রহমান এনে দিলেন গুরুত্বপূর্ণ এক ব্রেক থ্রু। দারুণ ফিল্ডিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হলো বাকি বোলারদের নৈপুণ্য। ঘুরে দাঁড়িয়ে ইংলিশদের হোয়াইটওয়াশ করল সাকিব আল হাসানের দল।

মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে মঙ্গলবার সিরিজের তৃতীয় ও শেষ টি২০তে সফরকারী ইংল্যান্ডকে ১৬ রানে হারাল বাংলাদেশ। ফলে তিন ম্যাচের টি২০ সিরিজে বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের ৩-০ ব্যবধানে বাংলাওয়াশ করেই ছাড়লো সাকিব বাহিনী। আগের দুই ম্যাচে যথাক্রমে ৬ ও ৪ উইকেটের ব্যবধানে জিতে টি২০ সিরিজ আগেই ঘরে নিশ্চিত করে রেখেছিল স্বাগতিকরা।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি২০ সিরিজে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের এই অবিস্মরণীয় সাফল্যে অভিনন্দন জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কি অসাধারণ এক প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখলো বাংলাদেশ! যে ম্যাচটি হেসেখেলেই বের করে নিয়ে আসছিলেন ডেভিড মালান আর জস বাটলার। সেই ম্যাচে পাশার দান একেবারে উল্টে দিলো সাকিব আল হাসানের দল। একটা সময় জয়টা কঠিনই মনে হচ্ছিল। ১৫৯ তাড়া করতে নেমে ১ উইকেটেই ১০০ রান তুলে ফেলেছিল ইংলিশরা। আর সেখান থেকে আর ৪২ রানে ৫ উইকেট হারায় ইংল্যান্ড। তার চেয়েও বড় কথা, টাইগারদের অসাধারণ বোলিংয়ে ৯ উইকেট হাতে রেখেও শেষ ৪৮ বলে মাত্র ৪৭ রান নিতে পারে ইংলিশরা। শেষ পর্যন্ত সফরকারীরা ৬ উইকেটে থামে ১৪২ রানে।

ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত ফরম্যাট টি২০তে বাংলাদেশের ভোগান্তির কথা ক্রিকেট দুনিয়ায় অজানা নয়। গত দুই বছরে অনুষ্ঠিত দুটি বিশ্বকাপেও ব্যর্থ হয়েছে তারা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এবার ওয়ানডেতে হারার পর টি২০ সিরিজ জেতা -সেটাও আবার ৩-০ ব্যবধানে -তাই যেমন স্মরণীয় হয়ে থাকবে, তেমনি এই ফল ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ। এখান থেকেই হয়তো শুরু হতে পারে এই সংস্করণকে আপন করে নেওয়ার পালা। তাইতো এই প্রথম কোনো বড় দলকে টি২০ সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করল বাংলাদেশ। এর আগে এমন অভিজ্ঞতা তাদের ছিল জিম্বাবুয়ে, আয়ারল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে।

এরআগে ১৫ ওভার শেষে বাংলাদেশের ছিল ১ উইকেটে ১৩১। হাতে ৯ উইকেট। মনে হচ্ছিল, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এবার বড়সড় সংগ্রহ গড়তে যাচ্ছে টাইগাররা। কিন্তু শেষ ৫ ওভারে হতাশার ব্যাটিং উপহার দিলো সাকিব আল হাসানের দল। মিরপুর শেরেবাংলায় সিরিজের তৃতীয় ও শেষ টি২০তে শেষ পাঁচ ওভারে মাত্র ২৭ রান তুলতে পেরেছে বাংলাদেশ। ২ উইকেটে স্বাগতিকদের ইনিংস থেমেছে ১৫৮ রানেই।

সিরিজ আগেই নিশ্চিত হয়ে গেছে। তৃতীয় ও শেষ টি২০ ম্যাচটি তাই বাংলাদেশের জন্য হোয়াইটয়াশ মিশন পূরণের। মিরপুর শেরেবাংলায় গুরুত্বহীন এই ম্যাচে টসভাগ্য গেছে ইংল্যান্ডের পক্ষে। টস জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ে পাঠান ইংলিশ অধিনায়ক জস বাটলার। তবে দুরন্ত ছন্দে থাকা বাংলাদেশ সিরিজের শেষ ম্যাচেও করেন উড়ন্ত সূচনা। লিটন দাস আর রনি তালুকদারের ব্যাটে চড়ে পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে বিনা উইকেটেই ৪৬ রান তুলে ফেলে টাইগাররা।

রনি তালুকদার অবশ্য পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে একটা সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু জোফরা আর্চারের বলে শর্ট থার্ড ম্যানে তার সহজ ক্যাচ ফেলে দেন রেহান আহমেদ। ১৭ রানে জীবন পান রনি। তবে সেই জীবন কাজে লাগাতে পারেননি রনি। যদিও আগে ব্যাট করে ২ উইকেটে ১৫৮ রান তোলে বাংলাদেশ। এক পর্যায়ে ১৮০ কিংবা এর বেশি রানের সম্ভাবনা জাগলেও শেষ পর্যন্ত ১৬০ রানও করতে পারেনি তারা। ১৫ ওভার শেষে তাদের সংগ্রহ ছিল ১ উইকেটে ১৩১ রান। কিন্তু শেষ পাঁচ ওভারে ভীষণ ভোগে স্বাগতিকরা। আরেকটি উইকেট খুইয়ে তারা স্কোরবোর্ডে যোগ করতে পারে কেবল ২৭ রান।

ম্যাচসেরা লিটন ফিফটি পেয়ে গিয়েছিলেন। ছন্দে থাকা শান্তও থিতু হয়ে পড়েছিলেন। উইকেট হাতে ছিল নয়টি। কিন্তু ১৬ থেকে ২০ ওভারে প্রত্যাশিত রান তুলতে পারেনি বাংলাদেশ। লিটন ৫৭ বলে খেলেন ৭৩ রানের ইনিংস। রনি তালুকদার ৩ চারে ২২ বলে করেন ২৪ রান। নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান। অধিনায়ক সাকিব ৬ বলে অপরাজিত ৪ রান করেন।

ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে ইংল্যান্ডকে চেপে ধরতে শুরুতেই উইকেট দরকার ছিল। অভিষিক্ত বাঁহাতি স্পিনার তানভীর ইসলাম প্রথম ওভারেই বাংলাদেশকে সাফল্য এনে দেন। উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে থাকা লিটন দারুণ দক্ষতায় স্টাম্পড করেন ফিল সল্টকে। টার্নে পরাস্ত হওয়া সল্ট ১ বল খেলে রানের খাতা খুলতে পারেননি। ড্রাইভ করার চেষ্টায় ক্রিজ থেকে বেরিয়ে গিয়ে সময়মতো ফিরতে পারেননি তিনি।

পরের ওভারে বল হাতে পেয়েই উইকেটের উল্লাস করেন অভিজ্ঞ পেসার তাসকিন। কিন্তু সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মাঠের আম্পায়ার মালানের বিপরীতে এলবিডব্লিউয়ের সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর রিভিউ নিয়ে বাঁচেন তিনি। রিপ্লে দেখে তৃতীয় আম্পায়ার সিদ্ধান্ত দেন যে ইনসাইড এজ হয়েছিল মালানের। যদিও সিদ্ধান্তটি নিয়ে বিতর্ক হওয়ার অবকাশ থাকে। ৬ রানে বেঁচে যাওয়া মালান এগোতে থাকেন। সঙ্গী হিসেবে পেয়ে অধিনায়ক বাটলারকে। তারা দ্বিতীয় উইকেটে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশকে ম্যাচে ফেরান বাঁহাতি মোস্তাফিজ। ১৪তম ওভারে আক্রমণে ফিরে ফিফটি করার মালানকে লিটনের ক্যাচ বানান তিনি। এই উইকেট দিয়ে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বোলার ও প্রথম পেসার হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে শততম উইকেট পূরণ করেন তিনি।

৪৭ বলে ৬ চার ও ২ ছয়ে ৫৩ রান করেন মালান। সঙ্গী হারিয়ে টেকেননি বাটলার। পরের বলেই মেহেদী হাসান মিরাজের দুর্দান্ত থ্রোতে রানআউট হন তিনি। ৪ চার ও ১ ছয়ে ৩১ বলে ৪০ রান আসে তার ব্যাট থেকে। দ্রুত ২ উইকেট পড়ে যাওয়ায় ইংলিশদের ভিত নড়ে যায়। মঈন ও ডাকেট ধাক্কা সামলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। ১৬তম ওভারে হাসান মাহমুদকে চার-ছয় মেরে তারা আনেন ১১ রান। ফলে শেষ চার ওভারে তাদের ৪০ রানের  প্রয়োজন ছিল। তবে ১৭তম ওভারে তাসকিন বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন ম্যাচ। একই ওভারে মঈন ও ডাকেটকে ছাঁটেন তিনি। ১০ বলে ৯ করে মঈন ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ দেন মিরাজের হাতে। ফুল ডেলিভারিতে ১১ বলে ১১ রান করা ডাকেটের স্টাম্প উপড়ে যায়।

পরের ওভারে মুস্তাফিজ খরচ করেন মোটে ৫ রান। এরপর ১৯তম ওভারে ৪ রান দিয়ে সাকিব সাজঘরে পাঠান স্যাম কারানকে। শেষ ওভারে ২৭ রানের কঠিন সমীকরণ মেলানো হয়নি ওকস ও জর্ডানের। প্রথম দুই বলেই চার হজমের পর তরুণ পেসার হাসান নিজেকে সামলে নেন। পরের চার বলে মাত্র ২ রান দিয়ে উচ্ছ্বাসে মাতান বাংলাদেশকে। তাইতো গ্যালারিভরা দর্শকের গগণবিদারী চিৎকার আর সমর্থনের জোয়ারে স্মরণীয় সিরিজ জয়ের শেষটাও হয় স্বপ্নের মতো।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৫৮/২ (লিটন ৭৩, রনি ২৪, শান্ত ৪৭*, সাকিব ৪*; কারান ০/২৮, ওকস ০/১২, রশিদ ১/২৩, আর্চার ০/৩৩, রেহান ০/২৬, মইন ০/১২, জর্ডান ০/২১)।

ইংল্যান্ড: ২০ ওভারে ১৪২/৬ (মালান ৫৩, সল্ট ০, বাটলার ৪০, ডাকেট ১১, মইন ৯, কারান ৪, ওকস ১৩*, জর্ডান ২*; তানভির ১/১৭, তাসকিন ২/২৬, সাকিব ১/৩০, হাসান ০/২৯, মুস্তাফিজ ১/১৪, মিরাজ ০/১৮)।

ফল: বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী।

সিরিজ: ৩ ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ৩-০ ব্যবধানে জয়ী।

ম্যাচসেরা : লিটন কুমার দাস।

সিরিজসেরা : নাজমুল হোসেন শান্ত।