ফরহাদ খান, নড়াইল: দেশের প্রথম ছয় লেনের কালনা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত করা হয়েছে। নির্ধারণ করা হয়েছে টোলের পরিমাণ। এ তথ্য জানিয়ে কালনা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক আশরাফুজ্জামান বলেন, ৩০ আগস্টের মধ্যে সেতুর মূল কাজ শেষ হয়েছে। এখন শুধুমাত্র সেতুতে লাইটিংয়ের কাজ চলছে। এ কাজও কয়েকদিনের মধ্যে শেষ হবে। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তারিখ ঘোষণা হলেই চূড়ান্ত হবে উদ্বোধনের দিনক্ষণ। সেই অপেক্ষায় আছে সেতু কর্তৃপক্ষসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসী। প্রহর গুণছেন যাত্রীবাহী বাসসহ অন্যান্য যানবাহন সংশ্লিষ্টরা।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে কালনা সেতু নির্মিত হয়েছে। ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘কালনা সেতু’র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কালনাঘাট থেকে ঢাকার দূরত্ব মাত্র ১০৮ কিলোমিটার। ফলে ঢাকার সঙ্গে নড়াইল, বেনাপোল, যশোর, খুলনাসহ আশপাশের সড়ক যোগাযোগ কোথাও ১০০ কিলোমিটার, কোথাও আবার ২০০ কিলোমিটার কমে যাবে।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সম্মতি পেলে অক্টোবরের যে কোনো দিন সেতুটি উদ্বোধন হবে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গত ৭ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ের গণমাধ্যম কেন্দ্রে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) আয়োজিত ‘বিএসআরএফ সংলাপ’-এ অংশ নিয়ে এ কথা বলেন মন্ত্রী। তবে যাত্রীসাধারণ, যানবাহন চালকসহ ভুক্তভোগীদের দাবি দ্রুত উদ্বোধনের দিনক্ষণ ঘোষণা করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসীর দুর্ভোগ লাগব করা হোক। যেহেতু, ৩০ আগস্টের মধ্যে কালনা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়েছে; ফলে যথাসম্ভব এ মাসের (সেপ্টেম্বর) মধ্যেই উদ্বোধন হলে কোটি কোটি মানুষের দুর্ভোগ ঘুচবে। ঢাকার সঙ্গে সড়ক পথে সরাসরি যোগাযোগ হবে সিলেট-তামাবিল-ঢাকা-ভাঙ্গা-নড়াইল-যশোর-বেনাপোল-কোলকাতা পর্যন্ত। এমনকি গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, খুলনা, সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর, বেনাপোল বন্দর, যশোরের নোয়াপাড়া নৌবন্দর, মেহেরপুর, মাগুরাসহ আশপাশের কয়েকটি জেলার সঙ্গে যোগাযোগের মাইলফলক রচিত হবে। সুফল মিলবে ভারত, কোলকাতা, আসামসহ দেশের বিভিন্ন জেলার সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে। নড়াইলের লোহাগড়ায় ইপিজেড (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) চালুসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
অন্যদিকে, দেশের স্মরণীয়-বরণীয়দের নামে কালনা সেতুর নামকরণের দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন পেশার মানুষসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।
বৃহত্তর যশোর উন্নয়ন পরিষদ ও নড়াইল জেলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক অবসরপ্রাপ্ত লেফট্যানেন্ট কর্নেল সৈয়দ হাসান ইকবাল বলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফট্যানেন্ট এম এম মতিউর রহমানের (বিএন) নামে কালনা সেতুর নামকরণের দাবি জানাচ্ছি। এ লক্ষে নড়াইল জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে গত ৬ জানুয়ারি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর সুপারিশপত্র পাঠানো হয়েছে। এছাড়া গত ৮ মার্চ নড়াইল জেলা সমিতির পক্ষ থেকেও সচিব বরাবর পত্র প্রেরণ করা হয়।
এছাড়া আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারবর্গের নামে কালনা সেতু নামকরণের দাবি করেছেন। অনেক আবার ‘বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ’, ‘চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান’, ‘চারণকবি বিজয় সরকার’, ‘জারিস¤্রাট মোসলেম উদ্দিন’, ‘ঔপন্যাসিক নীহার রঞ্জন গুপ্ত’, ‘ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা’সহ স্মরণীয়-বরণীয় ব্যক্তিদের নামে নামকরণের কথা জানিয়েছেন। যদিও সেতুমন্ত্রী ?বিএসআরএফ সংলাপে (৭ সেপ্টেম্বর) ‘মধুমতি সেতু’ নামকরণের কথা বলেছেন।
কালনা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) নড়াইলের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামান বলেন, কালনা দেশের প্রথম ছয় লেনের সেতু। নেলসন লোস আর্চ টাইপের (ধনুকের মতো বাঁকা) সেতু এটি। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬৯০ মিটার এবং প্রস্থ ২৭ দশমিক ১ মিটার। উভয় পাশে ছয় লেনের সংযোগ সড়ক প্রায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার। সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় প্রায় ৯৬০ কোটি টাকা। এশিয়ান হাইওয়ের ওপর অবস্থিত এটি। এতোদিন কালনা পয়েন্টে মধুমতি নদী ধারা বিছিন্ন ছিল। সেতু নির্মাণের ফলে সেই বিছিন্নতা আর রইল না।
প্রকল্প ব্যবস্থাপক আশরাফুজ্জামান জানান, ইতোমধ্যে কালনা সেতুর টোল হার নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বড় ট্রেইলার ৫৬৫টাকা, তিন বা ততোধিক এক্সসেল বিশিষ্ট ট্রাক ৪৫০টাকা, দুই এক্সসেল বিশিষ্ট মিডিয়াম ট্রাক ২২৫, ছোট ট্রাক ১৭০টাকা, কৃষি কাজে ব্যবহৃত পাওয়ার ট্রিলার ও ট্রাক্টর ১৩৫ টাকা, বড় বাসের ক্ষেত্রে ২০৫ টাকা, মিনিবাস বা কোস্টার ১১৫ টাকা, মাইক্রোবাস, পিকাপ, কনভারশনকৃত জিপ ও রে-কার ৯০ টাকা, প্রাইভেটকার ৫৫ টাকা, অটোটেম্পু, সিএনজি অটোরিক্সা, অটোভ্যান ও ব্যাটারিচালিত তিনচাকার যান ২৫ টাকা, মোটরসাইকেল ১০ টাকা এবং রিক্সা, ভ্যান ও বাইসাইকেল পাঁচ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।