নিজস্ব প্রতিবেদক : যশোর শহরের বাবুবাজার পতিতাপল্লী ঘিরে চার সদস্যের একটি শক্তিশালী মাদক সিন্ডিকেট বেপরোয়াভাবে কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধা ছাড়াই বীরদর্পে বিষাক্ত মদের ব্যবসা করছে সিন্ডিকেটের চার সদস্য। কোনভাবেই দমন করা যাচ্ছে না এই মাদক কারবারিদের। কেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একাধিকবার মাদক সিন্ডিকেট নিয়ে জাতীয়, আঞ্চলিক পত্রিকাসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশ হলেও তারা সব সময় থেকেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এখন তারা প্রচার করে বেড়াচ্ছে, যা লেখে লিখুক, কোনো ব্যাপার না আমাদের সাথে প্রশাসনের লোক ও বড় ভাইরা আছে। বরং লিখলে আমাদের প্রচার হচ্ছে।
মাদক সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে টিম লিডার আনারুল। এছাড়া তার সাথে রাসেল, ছোট মহসিন ও টাকুয়া সহযোগী হিসেবে রয়েছে। অত্যন্ত সুকৌশলে মাদক বিক্রি করছে তারা। তাদের নামে মাদক মামলাও রয়েছে।
পালের গোদা আনারুল বাবু বাজার পতিতালয়ের ২ নম্বর গলির এক যৌনকর্মীকে বিয়ের সুবাদে দীর্ঘদিন ধরে বাবু বাজার এলাকায় বসবাস করছে, সেই সাথে চালিয়ে যাচ্ছে অবৈধ মাদকের ব্যবসা। ওই যৌনকর্মীর ঘরকে আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী ভ্রাম্যমানভাবে ব্যবসা করতো। ওই সময় যশোরের পত্রপত্রিকায় তার এই ব্যবসার গোমর ফাঁস হলে সে সাতক্ষীরায় গ্রামের বাড়িতে গা ঢাকা দেয়। কিছুদিন সেখানে অবস্থানের পর সে আবারো পতিতালয় এলাকায় ফিরে এসে নতুন কৌশলে শুরু করে মাদকের ব্যবসা। সিদ্ধ ডিম বিক্রির আড়ালে সে প্রতিদিন পতিতালয়ের সামনে ও আশপাশে মাদক বিক্রি করতো। কিন্তু ইদানিং তার পুরোনো মাদক বিক্রির পদ্ধতি পরিবর্তন করে শরীরে মদের বোতল আর হাতে পানির বোতল রেখে খদ্দেরদের কাছে রান্না খাবারের সাথে সরবরাহ করছে। মূলত মদ খাওয়ার জন্য মুরগীর লটপটি সরবরাহ করে থাকে। তার এই বাংলা মদ, ইয়াবা ও গাঁজা আশপাশে তার অনুসারীদের প্রতিষ্ঠানে ও স্বপ্নপুরী হোটেলের পিছনে কার্নিসের উপরে রেখে খদ্দেরদের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করে থাকে।
সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য রাসেল (আনারুলের খুবই আস্থাভাজন) তাড়িখানা গলিতে একটি টোং ঘরে মদ রেখে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে খরিদ্দারের সাথে যোগাযোগ করে মদ সরবরাহ করে থাকে। আবার এখানে আসা খরিদ্দারদের কাছেও বিক্রি করে। এছাড়াও রাসেল তার বাসস্থান বিরামপুর এলাকায় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন জনের কাছে ভ্রাম্যমানভাবে মাদক (বাংলা মদ, ইয়াবা ও গাঁজা) সরবরাহ করে থাকে।
আরেক সদস্য ছোট মহসীন। পূর্বে টিম লিডার আনারুলের সাথে যোগ দিয়ে একসাথে মদ, গাঁজা ও ইয়াবার ব্যবসা করতো। ওই সময় ছোট মহসীন বাবুবাজার পতিতালয়ের সামনে মাসিক ভিত্তিতে স্বপ্নপূরী হোটেলের একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে মোবাইলের মাধ্যমে খরিদ্দারদের সাথে যোগাযোগ করে মাদক পৌঁছে দিতো। কেউ চাইলে আশপাশেও মদপানের ব্যবস্থা করে দিতো। সে নিজেই হোম ডেলিভারির মাধ্যমে মদ পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা চালু করে। তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে ফোন করলেই বাংলা মদ চাহিদা অনুযায়ী পৌছে যেত খদ্দেরের বাড়ি অথবা নির্দিষ্ট স্থানে। পত্রপত্রিকায় তার বিরুদ্ধেও ওই সময় সংবাদ প্রকাশ হলে গা ঢাকা দিলেও পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে পুনরায় পতিতালয় এলাকায় ফিরে পালের গোদা আনারুলের সাথে যোগ দিয়ে মদের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, ছোট মহসিন স্বপ্নপূরী আবাসিক হোটেলে একটি কক্ষ মাসিক ৬ হাজার টাকা দিয়ে বসবাস করতো । সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পতিতালয়ের আশপাশে ঘোরাঘুরি করে মদ বিক্রি শেষ হলে হোটেলে ঢুকে যেত। সুযোগ বুঝে পতিতালয়ে আসা লোকজনের কাছ থেকেও দালালির নামে প্রতারণা করে থাকে। কিন্তু প্রতারণার শিকার হয়েও লোকলজ্জার ভয়ে অনেকে মুখ খুলতে পারে না। এখন সে আবারও স্বপ্নপূরি হোটেলে থাকে এবং তাড়িখানা গলিতে তাকে নিয়মিত দেখা যায়।
সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য টাকুয়া ঝালাইপট্টির সামনে বৈদ্যুতিক খাম্বার পাশে কামারের দোকানের পিছনে বসে বিভিন্ন কায়দায় মাদক সরবরাহ করে থাকে।
এই সিন্ডিকেটটি মাড়–য়া মন্দির পতিতালয়ের সামনের বাংলা মদের ডিলারের কর্মচারী গৌর এর কাছ থেকে মদ কিনে আনে। এরপর প্রয়োজন মতো পানির সাথে নেশার ট্যাবলেট মিশিয়ে খদ্দেরদের কাছে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করে থাকে। ইয়াবা ও গাঁজা বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করে গ্রাহকদের কাছে ভ্রাম্যমাণভাবে বিক্রি করে থাকে।
গত ২০২০ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে বিষাক্ত মদ পান করে শহরে অন্তত ১৭ জনের মৃত্যু হয়। মদককাণ্ডের পর প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। মামলাও হয়। ওই সময় পালের গোদা হাসানসহ অনেকে গ্রেফতার হয়ে জেল খাটে। এ সময় বেশকিছু দিন থমকে ছিল মদ ব্যবসা। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় মদের ব্যবসা চালায় কয়েকটি সিন্ডিকেট। এরমধ্যে গত জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে সদরের আবাদ কচুয়া গ্রামে বিষাক্ত মদ পান করে তিনজনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় মদ বিক্রেতা বাবুলের নামে কোতয়ালি থানায় মামলা হয়। এ ঘটনা নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়। কিন্তু মাদককারবারীরা এখনো দাপটের সাথে তাদের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে।
এরপর থেকে প্রশাসন মাদক বিক্রির অভিযোগে আনারুল, রাসেল, টাকুয়া ও ছোট মহসীনকে বিভিন্ন সময় মাদকসহ আটক হলেও তারা বর্তমানে জামিনে বেরিয়ে আবারো পুরনো ব্যবসাকে নতুন কৌশলে চালু করেছে। তাদের ব্যবসার ধরনও ভিন্ন রকম। প্রথমে বুঝে ওঠার উপায় নেই যে তারা মাদকের ব্যবসা করছে। এদের কাছ থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রত্যন্ত এলাকায় চলে যাচ্ছে বিষাক্ত মদ। আর এই মদ খেয়ে মানুষ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে। এর আগের ঘটনাগুলো তদন্ত করলে মদ সরবরাহের ব্যাপারে এদের সম্পৃক্ততা উঠে আসবে বলে মনে করছে স্থানীয়রা।
এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন বাবুবাজার-ঝালাইপট্টি এলাকায় এই মাদক বিক্রেতাদের কারণে সবসময় পরিস্থিতি থাকে উত্তপ্ত। মদ সেবন করে অনেকে ঘোলাটে পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। প্রায় সময় এখানে হাতাহাতি-মারামারির পর্যায়ে চলে যায়। যৌনকর্মীরাও তাদের ভয়ে সবসময় তটস্থ থাকে। কিন্তু ভয়ে মুখ খোলার সাহস নেই তাদের। তারা প্রশাসনের কাছে দ্রæত জরুরি নজরদারির দাবি করেছে।
একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানিয়েছেন মাদক ব্যবসায়ীদের কোনো ছাড় নেই, বাবুবাজার এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের তথ্য আমাদের কাছে এসেছে। যেকোন সময়ে আমাদের অভিযান চলবে।
এ ব্যাপারে যশোর সদর ফাঁড়ির ইনচার্জ আব্দুল আলিম সাংবাদিকদের বলেন, আমার জানা নেই কারা বাংলা মদ ব্যবসা করে বা গাঁজাসহ অন্যান্য মাদকের ব্যবসা করছে। তবে আমি বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ খবর নিচ্ছি। এরকম অবস্থা হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।