মরিচ্চাপ নদী খননে জলাবদ্ধতা সমস্যা দূর হচ্ছে, সুফল পাবে কৃষক

এখন সময়: শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল , ২০২৪, ১২:৩১:৩৫ পিএম

শাকিলা ইসলাম জুঁই, সাতক্ষীরা  : সাতক্ষীরার প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা। বছরে ৪ থেকে ৫ মাস জলাবদ্ধতার কবলে পড়ে দুর্ভোগের শিকার হয় জেলার কয়েক লাখ মানুষ। বর্ষা মৌসুম আসলেই প্রতি বছর এতে ক্ষতি হয় লাখ লাখ হেক্টর ফসলি জমি ও মাছের। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জেলার অধিকাংশ নদ-নদী ও খাল দীর্ঘ দিন পলি পড়ে ভরাট হয়ে পানি নিষ্কাশনের দ্বার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকার ৪৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সাতক্ষীরায় মরিচ্চাপ ও বেতনা নদীসহ নদী সংলগ্ন ৮০টি খাল খনন কার্যক্রম শুরু করেছে। ইতিমধ্যে সাতক্ষীরা জেলা শহরের উপকণ্ঠ দিয়ে প্রবাহমান মরিচ্চাপ নদী খননেই বদলে যেতে শুরু করেছে মানুষের জীবন যাত্রার মান ও সাতক্ষীরার চিত্র। স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে দীর্ঘ দিন জলাবদ্ধতার কবলে থাকা সাতক্ষীরা শহর, সদর ও আশাশুনি উপজেলা এবং মরিচ্চাপ নদীর অববাহিকায় বসবাসরত লাখ মানুষের। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ সংলগ্ন বাকাল ব্রীজ থেকে আশাশুনি উপজেলার খোলপেটুয়া নদী পর্যন্ত প্রবাহমান ২৯ কিলোমিটার মরিচ্চাপ নদী খননের কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। ইতিমধ্যে ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বদলে যেতে শুরু করেছে এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মান, কৃষি, মৎস্য ও অর্থনীতি। কালের পরিবর্তন ও জলবায়ুর প্রভাবে ভরাট হয়ে যাওয়া মরিচ্চাপ নদী খননের ফলে চলমান খননকৃত এলাকায় পানি বৃদ্বি পেয়েছে। ইতিমধ্যে মরিচ্চাপ নদীর পানি ব্যবহার করে কৃষকরা ফলাতে শুরু করেছে তাদের স্বপ্নের ফসল ও মৎস্য ঘেরের চিংড়ি চাষ। পানি নিষ্কাশনের দার খুলে শুরু করায় চিংড়ী চাষী ও ঘের ব্যবসায়ীরা বেশ খুশি। এই শুষ্ক মৌসুমে আশে পাশের পুকুরে পানি না থাকায় মরিচ্চাপের অববাহিকায় বসবাসরত মানুষ গোসল থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করতে শুরু করেছে মরিচ্চাপের স্বচ্ছ পানি। আগামি নভেম্বর মাসে মরিচ্চাপ নদীর খনন কাজের মেয়াদকাল শেষ হবে। তবে মহাধুমধামে খনন কাজের কর্মযজ্ঞ চলমান থাকায় জুন মাসের মধ্যেই মরিচচ্চাপ নদীর খনন কাজ পুরোপুরি শেষ হবে বলে মনে করছেন সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আবুল খায়ের। খনন কাজ শেষ হলে জলাবদ্ধতার হাত থেকে পুরোপুরি রেহায় পাবে সাতক্ষীরা সদর উপজেলাবাসী। সুফল পাবে এখানকার হাজার হাজার কৃষক ও মৎস্য চাষি। 
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিনে পোল্ডার ১ ও ২, ৬-৮ এবং ৬-৮ এর সম্প্রসারন নিস্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বাকাল ব্রিজ থেকে আশাশুনি উপজেলার খোলপেটুয়া নদী পর্যন্ত ২৯.৩৬৫ কিঃ মিঃ মরিচাপ নদী পুন:খনন করা হচ্ছে। দু’টি পোল্ডার মিলে যার সর্বমোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৭ কোটি টাকা। অচিরেই খনন কাজ শেষ হলে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার কবল থেকে বাড়ি-ঘর ও ফসলি জমি রক্ষা পাবে। কৃষি ও মৎস্য ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হবে বলে মনে করছেন এখানকার কৃষকরা। 
স্থানীয় কৃষক শিমুলবাড়ীয়া গ্রামের নির্মল মন্ডল (৬১), পরিতোষ মন্ডল (৫২) বলেন, দীর্ঘ দিন পলি পড়ে মরিচ্চাপ নদী ভরাট হয়ে মরা খালে পরিণত হওয়ার কারনে বর্ষা মৌসুমে তাদের বসতবাড়ী ও ঘর পানিতে তলিয়ে থাকত। পানি নিষ্কাশনের অভাবে বছরে ৪ থেকে ৫ মাস জলাবদ্ধতার কবলে পড়তে হতো। কিন্তু মরিচাপ নদী পুনঃখনন কাজ শেষ হলে আমাদের বাড়ি-ঘর  ফসলি জমিগুলো জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা পাবে। আমরা কখনো ভাবিনি মরিচাপ নদী আবারও তার যৌবন ফিরে পাবে। নদী খননে কোন অনিয়ম হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তারা বলেন, আমরা তো ভালো বুঝিনা তবে মনে হচ্ছে খনন কাজ ভালো হচ্ছে। এই ভাবে খনন কাজ চললে আমরা সুফল পাবো। 
খেয়া মাঝি গোপাল মাখাল (৮২) বড় আক্ষেপ করে বলেন, ১৯৭৩ সাল থেকে দীর্ঘ দিন মরিচ্চাপে নৌকা চালিয়ে সংসার চালিয়েছি। নদীতে প্রথমে কাঠের ব্রীজ ও পরে পাকা ব্রীজ  হলে আমার নৌকা চালানো বন্ধ হয়ে যায়। তার পর থেকে নদীটি পলি পড়ে ভরাট হয়ে যায়। বর্ষা মৌসুমে আমরা পানিতে তলিয়ে থাকতাম, এবার মনে হচ্ছে আমরা সুদিন ফিরে পাবো,আর আমাদের কষ্ট পেতে হবেনা। মরিচাপ নদী খনন করায় প্রধান মন্ত্রী ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আবুল খায়ের জানান, মোট ২৯.৩৯৬ কিলোমিটার নদী খনন হচ্ছে। সাতক্ষীরার বাকাল ব্রীজ থেকে নৈয়কাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত পওর ১ এর অধীনে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত মরিচ্চাপ নদী খননের জন্য ১৭ কটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলনার শামীম আহসান, যশোরের নূর হোসেন, ঢাকার রাব্বানী কন্সট্রাকশন লিঃ ও পটুয়াখালির ওটিবিএল এমকে ইকেএ এই চার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। চুক্তি অনুযায়ী আগামি নভেম্বর মাসের মধ্যে খনন কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৭৫% কাজ শেষ হয়েছে। পুরোপুরি খনন হলে সাতক্ষীরার জলাবদ্ধতা নিরসনের পাশাপাশি কৃষি ও মৎস্য ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হবে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ জানান, পওর ২ এর অধীনে ৯.৩৬৫ কিঃ মিঃ নদী খননের জন্য ৩৩ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। যেটা নৈয়কাটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আশাশুনির খোলপেটুয়া নদী পর্যন্ত। আমাদের কর্মকর্তারা সার্বক্ষনিক খোঁজখবর নিচ্ছেন। খনন কাজ যে ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা যাবে বলে আমরা মনে করছি। পুরোপুরি মরিচ্চাপ নদী খনন কাজ শেষ হলে এবং তার শাখা খালগুলো পুনঃখনন হলে সাতক্ষীরা সদর, আশাশুনি তালা ও কলারোয়া উপজেলার জলাবদ্ধতা পুরোপুরি নিরসন হবে বলে মনে করছি।