নিজস্ব প্রতিবেদক: যশোর-খুলনা মহাসড়কের ভগ্নদশা কিছুতেই কাটছে না। এবার আরও আড়াই কিলোমিটার সড়ক ঢালাই করার জন্য দরপত্র আহবান করা হয়েছে। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ কোটি টাকা। তবে গত কয়েকদিনের বৃষ্টিপাতের পর সড়কটিতে আবারও দেখা দিয়েছে অসংখ্য ক্ষত। এতে করে যানবাহন চলাচলে সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাঘাত।
৩৮ কিলোমিটার উন্নয়নে ৩শ’ ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৮ সালের মে মাসে শুরু হয় যশোর-খুলনা মহাসড়কের উন্নয়ন কাজ। ২০২২ সালের জুনে সড়কের কাজ শেষ করা হয়েছিল। সড়কের নির্মাণকাজ চলমান থাকাবস্থায় ৮ কিলোমিটার সড়ক ফুলে ফেঁপে ওঠে। পরে ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ কিলোমিটার সড়ক ঢালাই করা হয়।
সওজ সূত্র জানায়, যশোর-খুলনা মহাসড়কের ৩৮ কিলোমিটারের মধ্যে ২৭ কিলোমিটার কাজ সমপন্ন করেছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহবুব এন্ড ব্রাদার্স, তমা কনস্ট্রাশন এন্ড কোং।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের ব্যস্ততম যশোর-খুলনা মহাসড়কের ৩৮ কিলোমিটার মেরামতে গত এক দশকে ব্যয় হয়েছে ৪০০ কোটি টাকার বেশি। এই এক দশকের প্রায় পুরো সময় ধরে চলা সাত দফা সংস্কারেও মেলেনি সমাধান। অনিয়ম ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় টেকেনি সড়কটি। যতবার মেরামত হয়েছে, ততবারই সড়কে সৃষ্টি হয়েছে উঁচু-নিচু, খানাখন্দ। ফলে সারাবছরই গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়কে চলাচল করতে হয় ভোগান্তি নিয়ে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আর সড়ক ও জনপথ কর্তৃপক্ষ, ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলের অজুহাত দেখিয়ে নিজেদের দায় এড়াচ্ছেন। এদিকে কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তুললেও একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হচ্ছে বারবার কাজ।
এ ব্যাপারে যশোর বাস মালিক সমিতির সভাপতি বদরুজ্জামান বাবলু বলেন, ‘নতুন হওয়া সড়ক পাঁচ মাসও যায়নি। তার মধ্যে এমন ফুলেফেঁপে ওঠা কখনো দেখিনি। আগে ঘষেমেজে আঁকাবাঁকা ঠিক করা হয়েছিল। বছরের পর বছর এই সড়কে কাজ করায় প্রচণ্ড যানজট সৃষ্টি হয়। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কাজে অনিয়ম করায় এমনটি হয়েছে। সরকার শতশত কোটি টাকা খরচ করলেও সড়কের মান উন্নয়ন করতে পারেনি।’ বর্তমানে গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে সড়কটিতে আবারও খানাখন্দে পরিণত হয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, যশোর শহর থেকে নওয়াপাড়ার রাজঘাট পর্যন্ত যশোর-খুলনা মহাসড়কের ৩৮ কিলোমিটারের বেশিরভাগ অংশে তৈরি হয়েছে খানাখন্দক আর উঁচু-নিচু ঢেউ। কোথাও উঠে গেছে বিটুমিনের আস্তরণ। ফুলেফেঁপে ওঠা সড়কে চলাচল করতে গিয়ে প্রায়ই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। ভাঙ্গা সড়কে হেলেদুলে ঝুঁকি নিয়ে চলতে গিয়ে এক ঘন্টার সড়ক পাড়ি দিতে হচ্ছে আড়াই থেকে তিন ঘন্টায়। এতে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই।
আফজাল হোসেন নামে এক বাস চালক বলেন, ‘১০ বছর ধরে দেখছি রাস্তা ঠিক করছে। ঠিকই হচ্ছে না। বাস নিয়ে চলাচল করতে গেলে গাড়ি হেলেদোলে। ধীরে ধীরে অনেক ঝুঁকি নিয়ে চলতে হয়।’
স্থানীয় বসুন্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সালেক হোসেন বলেন, ‘এই সড়কটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নওয়াপাড়া নৌবন্দর থেকে সারা দেশে পণ্য পরিবহন হয়। যশোর-খুলনা মহাসড়কে রাটিংয়ের কারণে প্রায়ই পণ্যবোঝাই ট্রাক উল্টে যায়। নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে রাস্তা নির্মাণের কারণে এমন অবস্থা।’ নজরুল ইসলাম নামের এক ট্রাকচালক বলেন, ‘সবচেয়ে খারাপ অবস্থা যশোর শহরের পালবাড়ী থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত। কিছু কিছু জায়গায় বিটুমিন উঠে গেছে। ভারী পণ্য নিয়ে যাতায়াতের সময় ট্রাক হেলেদুলে চলে।’
যশোর সওজ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছর এ পর্যন্ত সড়কটিতে মেরামত ও পূনর্নির্মাণ কাজ করা হয়েছে সাত দফায়। ব্যয় হয়েছে ৪০০ কোটি টাকার বেশি। যশোর নওয়াপাড়া সড়কটি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সাড়ে ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে মেরামত ও পুনর্র্নির্মাণ করা হয়। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত আরও ছয় দফা মেরামত অথবা পুনর্র্নিমাণকাজ হয়েছে। সাত দফার মধ্যে তিন দফার মেরামত ব্যয় কম, আড়াই থেকে ৯ কোটি টাকার মধ্যে। চার দফার ব্যয় বেশি, ১৬ থেকে ১৫৮ কোটি টাকা। বড় ঠিকাদারি কাজগুলো পেয়েছে তাহের ব্রাদার্স ও মাহবুব ব্রাদার্স (যৌথভাবে প্রায় ১৫৮ কোটি), তমা কনস্ট্রাকশন (প্রায় ১৪৮ কোটি ও ৯ প্রায় কোটি) এবং মোজাহার এন্টারপ্রাইজ ও রিমি নির্মাণ লিমিটেড (যৌথভাবে ৪১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা)।ঘুরেফিরে প্রতিবারই কাজ পেয়েছে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট প্রতিষ্ঠান তাহের ব্রাদার্স, মাহবুব ব্রাদার্স, তমা কনস্ট্রাকশন, মোজাহার এন্টারপ্রাইজ ও রিমি নির্মাণ লিমিটেড। দৌর্দণ্ড প্রতাপশালী এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। বরং অভিযোগ ওঠে, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকার কমিশন নিয়ে চুপ থেকেছেন তারা।
যশোরের বামগণতান্ত্রিক নেতা ও নাগরিক কমিটির সদস্য তসলিমুর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘অর্থের নিদারুণ অপচয় সেটা যশোর খুলনা মহাসড়কের কাজ দেখলে বুঝা যায়। এক দশকে কোটি কোটি টাকা সরকার খরচ করেছে, সেখানে ঠিকাদার ও সওজের কর্মকর্তা লুটপাট করেছে। সড়ক উন্নয়নের কাজে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কোনো নিয়মনীতি মানেনি। তারা গোঁজামিল দিয়ে ইচ্ছেমতো কাজ করেছে বলেই সড়কের এই অবস্থা।’
এদিকে সর্বশেষ মহাসড়কটির ১৬ কিলোমিটার অংশ ঢালাই করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে সাড়ে ৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে। যেসব ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে কাজ নিয়ে ছিল অভিযোগ; ফের তারাই করছেন এ কাজটিও।
সওজের প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া জানান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও সওজের পরামর্শ অনুযায়ী যশোর-নওয়াপাড়া সড়কের ১৬ কিলোমিটার সড়ক ঢালাই করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ৪ কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে। ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও আড়াই কিলোমিটারের জন্য দরপত্র আহবান করা হয়েছে।
অবশ্য সওজ ও বুয়েট সূত্র জানিয়েছে, সড়কটি টেকসই করার বিষয়ে মতামত নিতে যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেটিতে শেষ পর্যন্ত বুয়েটের প্রতিনিধি থাকেননি। বৈঠকের কোনো কার্যবিবরণীতেও তিনি সই করেননি।
সওজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, বুয়েটের প্রতিনিধির সঙ্গে মতের মিল ছিল না।
অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহন ঠেকাতে দেড় কোটির ওয়ে স্কেল প্রকল্প বিফলে
অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহন ঠেকাতে ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০২৩ সালে মহাসড়কের চেঙ্গুটিয়ায় ওজনস্কেল স্থাপন করা হলেও সেটি চালুর মাত্র ৩দিনের মাথায় বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন পড়ে থেকে ওয়ে স্কেলের যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। ফলে বাধাগ্রস্ত হয় অতিরিক্ত পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ। সওজ বিভাগ বলছে, স্কেলটি স্থাপন করা হলেও স্থানীয় ট্রাক ও ট্যাংকলরি মালিক সমিতির আপত্তির মুখে চালু করে আবার বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে সরকারি প্রকল্পটির প্রায় দেড় কোটি টাকা বিফলে গেছে।
একজন ট্রাকচালক বলেন, ‘আমরা নওয়াপাড়া থেকে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে সারা দেশে পৌঁছে দিয়ে থাকি। যেখান থেকে পণ্য বোঝাই করি, সেখানেই ওজন করে গাড়িতে তোলা হয়। ওয়ে স্কেল থাকলে তো ভালো। কয়েক দিন এই ওয়ে স্কেল চালু হলে ট্রাকে সড়কের নির্ধারিত পণ্যের তালিকার বাইরে বেশি পণ্য কেউ নিতে পারতেন না।’ যশোর জেলা ট্রাক ও ট্যাংকলরি মালিক সমিতির সভাপতি রেজাউল বিশ্বাস বলেন, ‘ওয়ে স্কেলটি চালু হলে আমরা আপত্তি জানিয়েছিলাম, এটা সত্য। আমাদের দাবি ছিল, সারা দেশে একযোগে ওয়ে স্কেল কার্যকর করতে হবে। শুধু নওয়াপাড়া এলাকায় এই স্কেল কার্যকর হলে সারা দেশের ব্যবসায়ীরা নওয়াপাড়া নৌবন্দর ব্যবহার করতে আসতেন না। ফলে বন্দরটি ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি হারাত। যে কারণে আমরা খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে গিয়ে বৈঠক করে এই দাবি জানিয়েছিলাম। সারা দেশে ওয়ে স্কেল কার্যকর না হলে শুধু যশোরে কার্যকর করা ঠিক হবে না।’
এদিকে কাজের মান নিয়ে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে সড়কে মাটি ফেলা ও ওভারলোডের যানবাহন চলাচল সড়কটির বেহাল দশার জন্য দায়ী করলেন সওজ যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া। তিনি বলেন, সড়ক টেকসই না হওয়ার জন্য শুধু ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বা সওজকে দায়ী করলে চলবে না। যাঁরা ধারণক্ষমতার চেয়ে ভারী যানবাহন চালান, তারা কিংবা তাঁদের নিয়ন্ত্রক সংস্থাও দায়ী। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান ভূইয়া বলেন, ‘কাজের মান নিয়ে বুয়েটের প্রতিনিধি দলও অভিযোগ তুলেনি। সমস্যা হলো সড়কের মাটির। একই সাথে অভার লোডিংয়ের কারণে।’