লোডশেডিংয়ে নাভিশ্বাস, স্থবির জনজীবন

যশোরে ১০ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভঙ্গ

এখন সময়: শুক্রবার, ১৭ মে , ২০২৪, ১২:৪৩:০৯ এম

আবদুল কাদের: যশোরে চলমান অতি তীব্র তাপমাত্রা গত ১০ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ২০১৪ সালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড অতিক্রম করে সোমবার ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়। ওই বছর জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ধারন করা হয় ৪২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ ছাড়া গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। খুলনা আঞ্চলিক আবহাওয়া অধিদপ্তর এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এদিকে, প্রচণ্ড গরমের মধ্যে বিদ্যুতের লোডশেডিং জনজীবনে সৃষ্টি করেছে নাভিশ্বাস।

এদিন যশোরে দিনের বেলায় লোডশেডিং হয়েছে কমপক্ষে ৫ ঘণ্টা। এর আগে এতো লোডশেডিং হয়নি। শহরের চেয়ে গ্রামে লোডশেডিংয়ের অবস্থা আরও খারাপ। গ্রামে প্রায় প্রতিদিনই দিনরাত মিলিয়ে ৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। এতে ধান ঝাড়াই-মাড়াই ব্যাহত হচ্ছে। অসহনীয় গরমে হাঁসফাঁস করছে প্রাণীকূলও। সারাদিন রোদ আর প্রচণ্ড গরমে স্থবিরতা নেমে এসেছে কর্মক্ষেত্রেও।

আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, চলতি এপ্রিল মাস থেকেই এই জেলায় বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। চলতি মৌসুমে যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল গত ২০ এপ্রিল ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি। এর আগে ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল ৪২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। সেটির রের্কড ভেঙে সোমবার তাপমাত্রার পারদ ওঠে ৪২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এর আগে যশোরে ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে ৪৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ।

তীব্র তাপপ্রবাহে যশোরের সাধারণ মানুষের জীবযাত্রা দুর্ভোগের মুখে পড়েছে। শহরে দিনের বেলায় লোকজনের উপস্থিতি কমে গেছে। তিন চাকার যানবাহনের চালকরা রয়েছেন চরম ভোগান্তিতে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ মুজিব সড়ক ও দড়াটানা মোড় থেকে শুরু করে অন্যান্য সড়ক তীব্র দাবদাহে প্রায় জনশূন্য দেখা যাচ্ছে। মানুষের উপস্থিতি যেমন কম তেমনি যানবাহনের উপস্থিতিও। অল্পকিছু ইজিবাইক ও রিকশা দেখা গেলেও যাত্রীর অপেক্ষায় চালকদের মোড়ে মোড়ে বসে থাকতে দেখা গেছে।

শহরের বকুলতলায় বসে থাকা রিকশা চালক হাফিজুর রহমান বলেন, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহর ফাঁকা হয়ে যায়। এতো গরমে মানুষ বের হবে কি করে? আমরা পেটের দায়ে বের হয়েও যাত্রী পাচ্ছি না। ভাড়ার রিকশা চালাই। মহাজনকে দেয়ার মতো টাকা এখনো আয় হয়নি।’

যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি গ্রামের কৃষক সাইদুর রহমান বলেন, সোমবার সকাল সাতটা থেকে দুপুর দুইটার মধ্যে চার বার বিদ্যুৎ বন্ধ ছিল। প্রতিবার ২০ থেকে ২৫ মিনিট করে মোট দেড় ঘন্টা মতো লোডশেডিং ছিল। এ ছাড়া রোববার রাত ১২টার দিকে একবার বিদ্যুৎ গিয়ে ২০ মিনিট বন্ধ থাকে। গত কয়েকদিন ধরে বিদ্যুতের  এমনই পরিস্থিতি আমাদের গ্রামে।

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর মহাব্যবস্থাপক আবদুল লতিফ বলেন, গরমে এখন পিক আওয়ারে ১২৫ থেকে ১৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে কখনো পুরোটা পাওয়া যাচ্ছে। আবার কখনো দুই এক মেগাওয়াটে সংকট থাকছে। সোমবার সকালে দুই মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি ছিলো। ২০ মিনিট করে বিদ্যুৎ বন্ধ রেখে ঘাটতি পূরণ করা হয়েছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর চাহিদা রয়েছে ১৭৫ মেগাওয়াট।

শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ওজোপাডিকো) যশোর-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী নাসির উদ্দিন বলেন, আমাদের গ্রাহক ৫৬ হাজার। সোমবার বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৬৫ মেগাওয়াট। বরাদ্দ পাওয়া যায় ৪৫ মেগাওয়াট। যশোর-২ এর আওতায় গ্রাহক রয়েছে ৬০ হাজার। এখানে গতকাল বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৬৫ মেগাওয়াট। পাওয়া গেছে ৪৫ মেগাওয়াট। গতকাল হঠাৎ বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল। যে কারণে লোডশেডিং হয়েছে।

এদিকে, গরমের কারণে বেড়েছে ডায়রিয়া রোগী। যশোর জেনারেল হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে পাঁচ শয্যার বিপরীতে ভর্তি রয়েছেন ২৫ রোগী। যার মধ্যে ১১ জন শিশু। সোমবার মোট রোগী ছিল ১১ জন। গতকাল নতুন করে (বিকাল ৬টা পর্যন্ত) ভর্তি হয়েছেন ২৪ জন। এ তথ্য দিয়েছেন যশোর জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স হোসনে আরা বেগম।

লাগাতার তাপদাহের কারণে রোদের মধ্যে বাইরে না বের হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন যশোরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। যশোর মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক ডা. আলাউদ্দিন আল মামুন বলেন, এই গরমে ডায়রিয়া, বমি ও পেটে ব্যথার রোগী বেশি ভর্তি হচ্ছে। রোগীদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা বেশি।

তিনি বলেন, এই সময় ডায়রিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, সর্দি-কাশি, পক্স, হিট স্ট্রোক, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি হতে পারে। প্রচণ্ড গরম থেকে মুক্তি পেতে কেউ যেন ডিপ ফ্রিজের পানি পান না করে। এ সময় প্রচুর পানি, ডাবের পানি ও দেশি ফলমূল খাওয়া প্রয়োজন। দিনমজুর বিশেষ করে কৃষকরা বেলা ১১টার মধ্যে ও বিকেলে তাপমাত্রা যখন কম থাকে সেই সময় কাজ করলে গরমে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম।

যশোরে লাগাতার তাপদাহের কারণে জেলা প্রশাসন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জরুরি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের বিষয়ে ভাবছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার  বলেন, দীর্ঘদিন ধরে যশোরাঞ্চলে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে আমরা দ্রুত কিছু স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সতর্কতা বার্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করতে যাচ্ছি। লোকজন যেন এই রোদে ঘর থেকে বের না হয়। প্রচুর পরিমাণে পানি পান করে ইত্যাদি।