ক্রীড়া ডেস্ক: দর্শকে ঠাসা গ্যালারি তখন যেন প্রায় ঘুমিয়ে। শশ্মানের নিরবতা হয়তো নয়, তবে পরিবেশ থমথমে। সাকিব আল হাসান ও আফিফ হোসেনের দ্রুত বিদায়ে হঠাৎ জাপ্টে ধরেছে হারের শঙ্কা। কিন্তু ক্রিস জর্ডানের বলে নাজমুল হোসেন শান্তর বাউন্ডারিতে ওই গ্যালারিই জেগে উঠল গর্জনে। সেই উত্তাল জোয়ারেই ভেসে গেল সব শঙ্কা। মেহেদী হাসান মিরাজের অলরাউন্ড পারফরম্যান্স আর শান্তর দায়িত্বশীল ইনিংস বাংলাদেশকে পৌঁছে দিল জয়ের ঠিকানায়।
আপাত সহজ ম্যাচ হুট করে কঠিন করে ফেললেও শেষ পর্যন্ত হতাশায় পুড়তে হলো না বাংলাদেশকে। ৪ উইকেটের জয়ে নিশ্চিত হয়ে গেল সিরিজ জয়।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম দ্বিপাক্ষিক সিরিজে জয় ধরা দিল প্রথম দুই ম্যাচেই। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে খেলতে নেমে ইংল্যান্ড হেরে গেল প্রথম সিরিজেই।
মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে রোববার ইংলিশদের ১১৭ রানে আটকে রেখে বাংলাদেশ লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ৭ বল বাকি রেখে।
গত বিশ্বকাপে স্রেফ একটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাওয়া মিরাজ টি-টোয়েন্টি একাদশে ফিরেই হয়ে উঠলেন জয়ের নায়ক। স্পিন সহায়ক উইকেটে দুর্দান্ত বোলিংয়ে ৪ ওভারে ১২ রানে তার শিকার ৪ উইকেট। কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে তার ক্যারিয়ার সেরা বোলিং। পরে রান তাড়ায় পাঁচে নেমে খেলেন ২ ছক্কায় ১৬ বলে ২০ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস।
তবে শান্তর ইনিংসটি না হলে মিরাজের এই পারফরম্যান্সও যেতে পারত বিফলে। আগের ম্যাচে ঝড়ো ফিফটি করা ব্যাটসম্যান এবার ব্যাটিং প্রতিকূল উইকেটে ম্যাচ পরিস্থিতির দাবি মিটিয়ে ৪৭ বলে খেলেন ৪৬ রানের অপরাজিত ইনিংস।
ইংল্যান্ডের দুর্ভোগের শুরু টস হার দিয়ে। এই নিয়ে চলতি বছর তিন সংস্করণ মিলিয়ে ১০ ম্যাচ খেলে সবকটিতেই টস হারল ইংলিশরা।
টপ অর্ডারে এ দিন বড় পরিবর্তন আনে তারা। ওপেনিং থেকে সরে যান জস বাটলার। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির পর প্রথম এই সংস্করণে ওপেন করলেন না ইংল্যান্ড অধিনায়ক।
ফিল সল্টের সঙ্গে ইনিংস শুরু করেন দাভিদ মালান। আগে বিদায়ও নেন মালানই। তৃতীয় ওভারে তাসকিনের বলে থার্ডম্যান সীমানায় ধরা পড়েন তিনি হাসান মাহমুদের হাতে।
ইংল্যান্ড অবশ্য সামলে নেয় অনেকটাই। মুস্তাফিজুর রহমানের শর্ট বলে অনায়াসে ছক্কা মারেন সল্ট, নাসুম আহমেদকে স্লগ সুইপে সীমানা ছাড়া করেন মইন। পাওয়ার প্লেতে ৫০ রান তুলে ফেলে তারা।
পরের ওভার থেকেই ম্যাচের চিত্র বদলের শুরু সাকিব আল হাসানের হাত ধরে। বাংলাদেশ অধিনায়ককে ফিরতি ক্যাচ দেন দারুণ খেলতে থাকা সল্ট (১৯ বলে ২৫)।
পরের ওভারে ইংল্যান্ডকে বড় ধাক্কা দেন হাসান মাহমুদ। আচমকা এক দুর্দান্ত ইয়র্কারে বোল্ড করে দেন তিনি চারে নামা বাটলারকে। ইংলিশ অধিনায়ক প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন বল ঠেকাতে গিয়ে।
এরপর দৃশ্যপটে মিরাজের আবির্ভাব এবং একের পর এক উইকেট হারিয়ে ইংলিশদের হাঁসফাঁস। প্রথম ওভারে মইন আলিকে (১৭ বলে ১৫)। পরে এক ওভারে ফিরিয়ে দেন তিনি স্যাম কারান ও ক্রিস ওকসকে। নিজের শেষ ওভারে ক্রিস জর্ডানকে ফিরিয়ে তিনি পূর্ণ করেন চার উইকেট।
ইংল্যান্ডের ব্যাটিং অর্ডারে গভীরতা ছিল না খুব একটা। বাংলাদেশ তা কাজে লাগায় ভালোভাবেই। পাঁচে নেমে বেন ডাকেট ২৮ বলে ২৮ করে দলকে পার করান একশ। অভিষিক্ত রেহান আহমেদ শেষ দিকে করেন ১১ রান। তার পরও ১২০ পর্যন্ত যেতে পারেনি তারা।
বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব এ দিন ব্যবহার করেন ৮ জন বোলার। ১ ওভারে ১৩ দেওয়ার পর আর বোলিং পাননি নাসুম। দারুণ বোলিং করলেও হাসানের ২ ওভার বাকি রয়ে যায়। উইকেটে দুই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান দেখেই হয়তো নাজমুল হোসেন শান্ত ও আফিফ হোসেনের অফ স্পিন কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন অধিনায়ক।
রান তাড়ায় বাংলাদেশের শুরুটা খুব ভালো হয়নি। তৃতীয় ওভারে স্যাম কারানকে পুল করে ডিপ স্কায়ার লেগে সহজ ক্যাচ দেন লিটন দাস (৯)। আরেক ওপেনার রনি তালুকদার অস্বস্তিময় উপস্থিতি শেষে ফেরেন ১৪ বলে ৯ রান করে।
শান্ত অবশ্য শুরু থেকেই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তৌহিদ হৃদয়ের সঙ্গে তার জুটি দলকে এগিয়ে নেয় শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে। হৃদয়ও ছিলেন সাবলিল। আদিল রশিদের লেগ স্পিনে বাউন্ডারি মারেন তিনি এক ওভারে দুটি।
তবে হৃদয় উইকেট উপহার দেন আরেক লেগ স্পিনার রেহান আহমেদকে। অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের শর্ট বলে বাজেভাবে ক্যাচ দিয়ে বসেন তিনি পয়েন্টে (১৮ বলে ১৭)।
শান্ত আর মিরাজের জুটি সেখান থেকে দলকে আরও এগিয়ে নেন জয়ের দিকে। পরপর দুই ওভারে রশিদ ও মইনের বলে ছক্কা মারেন মিরাজ। ৩২ বলে ৪১ রানের জুটি গড়েন দুজন, ম্যাচের প্রেক্ষাপটে যা অমূল্য।
এই জুটি ভাঙেন আক্রমণে ফেরা জফ্রা আর্চার। তার বাড়তি লাফানো বলে পুল করতে গিয়ে উইকেট হারান মিরাজ।
ম্যাচ তখন বাংলাদেশের প্রায় মুঠোয়। কিন্তু অধিনায়ক সাকিব ক্রিজে গিয়ে উইকেট বিলিয়ে দেন শূন্য রানে। আর্চারের বলে আফিফ বোল্ড হয়ে যান বাজে শটে। বলের ছোবলে একটি বেল উড়ে গিয়ে পড়ে প্রায় সীমানার কাছে। হঠাৎই প্রাণ ফেরে ম্যাচে। জেগে ওঠে ইংল্যান্ডের সম্ভাবনা।
কিন্তু শান্ত ছিলেন বাংলাদেশের নির্ভরতা হয়ে। তিনিই ভরসা জোগান দলকে। জর্ডানের বলে তার ওই বাউন্ডারির পর তাসকিনের জোড়া বাউন্ডারিতে শেষ ওভারের আগেই ম্যাচ শেষ।
সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে দুপুর ৩টায় শুরু হওয়া ম্যাচেও গ্যালারি ভরিয়ে তোলা দর্শকেরা উল্লাসে মেতে মাঠ ছাড়েন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের হারানোর তৃপ্তিকে সঙ্গী করে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ইংল্যান্ড: ২০ ওভারে ১১৭ (সল্ট ২৫, মালান ৫, মইন ১৫, বাটলার ৪, ডাকেট ২৮, কারান ১২, ওকস ০, জর্ডান ৩, রেহান ১১, রশিদ ১*, আর্চার ০, তাসকিন ৪-০-২৭-১, মুস্তাফিজ ৪-০-১৯-০, নানুম ১-০-১৩-০, সাকিব ৩-০-১৩-১, হাসান ২-০-১০-১, মিরাজ ৪-০-১২-৪, শান্ত ১-০-৯-০, আফিফ ১-০-৭-০)।
বাংলাদেশ: ১৮.৫ ওভারে ১২০/৬ (লিটন ৯, রনি ৯, শান্ত ৪৬*, হৃদয় ১৭, মিরাজ ২০, সাকিব ০, আফিফ ২, তাসকিন ৮*; কারান ৩-০-১৫-১, ওকস ১-০-৭-০, আর্চার ৪-০-১৩-৩, মইন ৪-০-২৫-১, রশিদ ৪-০-২৮-০, রেহান ২-০-১১-১, জর্ডান ০.৫-০-১৫-০)।
ফল: বাংলাদেশ ৪ উইকেটে জয়ী।
সিরিজ: ৩ ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ২-০তে এগিয়ে।
ম্যান অব দা ম্যাচ: মেহেদী হাসান মিরাজ।