নিজস্ব প্রতিবেদক : বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও সামাজিক অসাম্যকে কেন্দ্র করে সত্তরের দশকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনপদে সশস্ত্র চরমপন্থী গোষ্ঠীর উত্থান হয়। এরপর খুলনা ও বরিশাল বিভাগে একের পর এক খুন-ডাকাতির মতো অপরাধ সংঘটিত হতে থাকে। এভাবে টানা দুই যুগেরও বেশি সময় এ জনপদে নিজেদের আধিপত্য ধরে রেখেছিল চরমপন্থী গ্রুপগুলো। তবে র্যাব প্রতিষ্ঠার পর বেশ কয়েকজন চরমপন্থী গ্রুপের শীর্ষ নেতৃত্ব ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যান। গ্রেফতার হয়ে জেলেও যান অনেকে। কেউ কেউ জীবন বাঁচাতে প্রতিবেশী দেশেও আশ্রয় নেন। তবে গত বছর গণ-অভ্যুত্থানের ফলে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পুনরায় চরমপন্থী গ্রুপগুলো সক্রিয় হতে থাকে। এসব গ্রুপের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে না পারলে আসন্ন নির্বাচনে তারা বড় ধরনের হুমকির কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের থানাগুলোতে মোট ৫৩৫টি হত্যা মামলা নথিভুক্ত হয়। এর মধ্যে খুলনা বিভাগে ৩৪৯ আর বরিশাল বিভাগে ১৮৬টি মামলা হয়। খুলনা বিভাগে থানাগুলোয় জানুয়ারিতে ৩০টি, ফেব্রুয়ারিতে ২৩, মার্চে ৩৭, এপ্রিলে ৩৪, মে মাসে ৪১, জুনে ৩১, জুলাইয়ে ২৭, আগস্টে ৩৫, সেপ্টেম্বরে ২৮, অক্টোবরে ৩৯ ও নভেম্বরে ২৪টি হত্যা মামলা নথিভুক্ত হয়।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, গত বছরের ৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কারাগারে থাকা চরমপন্থী নেতাদের অনেকেই বেরিয়ে গেছেন। পাশাপাশি আরো যেসব চরমপন্থী নেতা প্রতিবেশী দেশে আত্মগোপনে ছিলেন, তারা দেশে চলে আসেন। আবার ওই সময়ে পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনা থেকে বিপুলসংখ্যক অস্ত্র লুট হয়ে যায়। এসব অস্ত্রের মধ্যে এখনো এক হাজারের বেশি অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ফলে একদিকে চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের তৎপরতা অন্যদিকে পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার না হওয়ায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নির্বাচনী নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে তাদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি পুলিশের খোয়া যাওয়া অস্ত্র উদ্ধারে আরো জোরদার অভিযান পরিচালনার তাগিদ দেন তারা। তা না হলে দুই দশক পরে ফের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ তৈরি হবে বলে মত তাদের।
গণতান্ত্রিক অভিযানের মাধ্যমে অগণতান্ত্রিক শক্তিকে প্রতিহত করার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের একেক অঞ্চলের রাজনৈতিক বাস্তবতা একেক রকম। সেই রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অনুসরণ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তিভেদে ভিন্নতা আছে। এ ভিন্নতা ও স্বার্থান্বেষী মহলের রাজনৈতিক শক্তি অর্জনের উপায় হিসেবে এ ধরনের অগতান্ত্রিক সহিংস শক্তির উত্থান এবং নানাভাবে লালন-পালনের চেষ্টা স্বাধীনতার পর থেকে হয়েছে। এ শক্তির উপস্থিতি এখন দৃশ্যমান হয়েছে। ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পরে সেই শক্তিগুলোর নতুন রূপ লক্ষ করা যাচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘পুরনো শক্তির নতুন রূপে ফিরে আসা গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। গণতন্ত্রে উত্তরণের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট এলাকায় এ শক্তিকে মোকাবেলায় আইন প্রয়োগের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন। যাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার গুরুতর অভিযোগ আছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই কেবল জনগণের শক্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। এ অগণতান্ত্রিক সহিংস গ্রুপগুলোকে যারা পৃষ্ঠপোষকতা করেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। এতে পরবর্তী সময়ে আর এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য বলছে, ১৯৯৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে চরমপন্থীদের হাতে নিহত হন চার শতাধিক মানুষ। পাবনা, সিরাজগঞ্জ এলাকায় সত্তরের দশকে কিছু উগ্র বামপন্থী দল থাকলেও এখন আর তারা নেই। এর মধ্যে রয়েছে জাসদ গণবাহিনী, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (সর্বহারা), লাল পতাকা এবং গণমুক্তি ফৌজের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠী। অনেকেই দলছুট হয়ে চুরি-ডাকাতির মতো কাজ করতে শুরু করে। এখন তাদের অনেকেই আবার সংগঠিত হয়ে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। বিভিন্ন পন্থায় অস্ত্র সংগ্রহেরও চেষ্টা করছে। আসন্ন নির্বাচনে তাদের প্রভাব বিস্তারের শঙ্কা রয়েছে।
যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল বাশার জানান, চরমপন্থিদের কোন আস্তানা যশোরে নেই। কেউ যদি অপরাধ করতে চায়, তাহলে তাদেরকে কঠোরভাবে দমন করা হবে। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সমপন্নের জন্য আমাদের সব ধরণের প্রস্তুতি রয়েছে বলে তিনি জানান।
আসন্ন নির্বাচন ঘিরে পুলিশের সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানান পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন। তিনি বলেন, ‘দেশের সবগুলো অঞ্চলকে গুরুত্ব দিয়েই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়। তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়। ফলে নির্বাচনী নিরাপত্তা নিয়ে কোনো ধরনের শঙ্কা নেই।’