বিদ্যুতের ঘনঘন লোডসেডিং আর ভ্যাপসা গরমে অবস্থা ভয়াবহ

এখন সময়: শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল , ২০২৪, ০৭:১৩:৩৭ এম

বিল্লাল হোসেন: যশোরে তাপমাত্রার দাপট চলছে। জ্যৈষ্ঠ মাসে আগুন ঝরাচ্ছে সূর্য। গরমের তীব্রতায় ছোটবড় সবার হাঁসফাঁস অবস্থা। সূর্যের প্রচণ্ড তাপে যেন গা পুড়ে যাচ্ছে। ফ্যানের বাতাসেও গরম অনুভূত হচ্ছে। আবার দাবদাহে অতিষ্ঠ মানুষ ছায়া জায়গায় আশ্রয় নিচ্ছেন। এছাড়া এই অবস্থায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সব বয়সী মানুষ। আবার  নানা ধরণের সবজির ক্ষতি হচ্ছে। দাবদাহের কারণে সারাদেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮ম ও নবম শ্রেণির অর্ধবার্ষিকী ও দশম শ্রেণির প্রাক নির্বাচনী পরীক্ষা ৮ জুন স্থগিত করা হয়েছে। এর আগে ৫ জুন থেকে ৯ জুন পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ করা হয়।

বুধবার যশোরে তাপমাত্রার পারদ ছুঁয়েছে সর্বোচ্চ ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ভ্যাপসা গরমের মধ্যে বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিং  মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। এ যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়া। এই অবস্থার মধ্যে রাতে মানুষের ঘুমের ব্যাহত হচ্ছে। এদিকে, গরম ও লোডশেডিংকে পূঁজি করে চার্জার ফ্যান বেশি দামে বিক্রির সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।

যশোর বিমান বন্দর সংলগ্ন আবহাওয়া অফিস বলছে, বুধবার যশোরে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার ছিলো ৩৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও সোমবার ছিলো ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস, রোববার ছিলো ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, শনিবার ছিলো ৪০ দশকি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও শুক্রবার ছিলো ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী কারণ আরো কয়েকদিন অসহনীয় তাপমাত্রায় পুড়তে হবে মানুষকে।

যশোর সদর উপজেলার দৌলতদিহি গ্রামের সবজি চাষি হাফিজুর রহমান জানান, সকালে সুর্য উঠার সাথে-সাথে তীব্র রোদ। বেলা বাড়ার সাথেই রোদ যেন আগুনের ফুলকি হয়ে ঝরছে। বিশেষ করে দুপুরের পর আগুনঝরা রোদের তেজে বাইরে বের হওয়া মুশকিল হয়ে পড়ছে। বুধবার দুপুরে তাপ সহ্য করতে না পেরে তিনি পটল ক্ষেতের পরিচর্যা না করে বাড়িতে ফিরে আসেন।

বুধবার বিকেল সাড়ে ৫ টা। মাথার ওপর থেকে সূর্য তখন কিছুটা পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। কিন্তু ভ্যাপসা গরম কমছে না। প্রচণ্ড এই গরমে সব বয়সী মানুষের  হাঁসফাঁস অবস্থা।  গরমে ঘরের বাইরে বের হলেই জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠছে।

দৌগাছিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান ও শ্যামনগর গ্রামের রফিকুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরে তারা চুড়ামনকাটি বাজার থেকে মোটরসাইকেলযোগে সাতমাইলের দিকে যাচ্ছিলেন।  রাস্তা থেকে গরম তাপ মুখে এসে লাগছে। কড়া রোদে পুড়ে যাচ্ছে গা। মাথার ওপরের নীল আকাশটা যেনো তাঁতালো কড়াইয়ের রূপ নিয়েছে। রোদের খরতাপে অসহনীয় অবস্থায় পড়ছেন তাদের মতো অনেকেই।

বৃদ্ধ শামসুর রহমান জানান, গরমে জীবন যাই যাই অবস্থা। ফ্যানের বাতাসও শরীরে বিধছে আগুনের হুলকার মতো। তাই অনেকেই ঘর ছেড়ে বুড়ি ভৈরব নদের তীর সহ গাছেন নিচে বসে গিয়ে বসছে।  প্রচন্ড গরমে মোটেও শান্তি পাচ্ছি না। কোন কাজ না করলেও ঘামে শরীর ভিজে যাচ্ছে।  এদিকে দিনের সাথে রাতেও পাল্লা দিয়ে গরম পড়ছে। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে মানুষ অস্বস্তিতে রয়েছে।  চান্দুটিয়া গ্রামের হাসি বেগম জানান, সারারাতে সর্বোচ্চ দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে।  আর দিনের বেলার কথা নাই বা বললাম। শফিয়ার রহমান জানান, সারাদিন রোদে পুড়ে কাজ করে রাতের বালিশে মাথা দেয়ার সাথে বিদ্যুৎ থাকছে না। ফলে তার মতো অনেকেই শান্তি করে ঘুমাতে পারছেন না। 

যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আঞ্জুয়ারা বেগম জানান, মঙ্গলবার বাজারে গিয়েছিলেন একটি চার্জার ফ্যান কেনার জন্য। দাম শুনে রীতিমতো অবাক হয়ে যান।  গরমের কারণে সাড়ে ৮ হাজার টাকা দিয়ে একটি চার্জার ফ্যান কিনতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। কয়েকদিন আগেও ফ্যানটির দাম ছিলো ৪ হাজার ৫ টাকা। আঞ্জুয়ারা বেগমের অভিযোগ, গরম ও লোডশেডিংকে পূঁজি করে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা চার্জার ফ্যানের দাম দ্বিগুণ বাড়িয়েছেন। তারপরেও বাড়তি টাকা দিয়ে তার মতো অনেক মানুষ চার্জার ফ্যান কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। নিয়মিত বাজার মনিটরিংয়ের দাবি জানিয়েছেন তিনি। সবজি চাষি শহিদুল ইসলাম ও জামাল উদ্দিন জানান, তাপদহে পটলসহ বিভিন্ন ধরণের সবজি ক্ষেতের ক্ষতি হচ্ছে।

স্কুলছাত্রী তাসনিয়া নূসরাত, হাসিবুর রহমান জানান, প্রচণ্ড গরমের মধ্যে পরীক্ষা দিতে গিয়ে তাদের মতো অনেক ছাত্রছাত্রী হাঁফিয়ে উঠেছে। পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণার পর কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেয়েছে। ওষ্ঠাগত গরমে মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। প্রখর রোদের মধ্যে জীবিকার সন্ধানে রিকশা ভ্যান চালাতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এসব মানুষের ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই।

যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আব্দুস সামাদ জানান, প্রচণ্ড গরমের কারণে হাসপাতালে সকল বয়সের রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। শিশু রোগীদের ক্ষেত্রে

তিনি অভিভাবকদের পরামর্শ দিয়ে বলেন, শিশুদের বেশি বেশি তরল খাবার খাওয়ান। রোদে ঘোরাঘরি করতে দেয়া যাবেনা। খোলামেলা ঠান্ডা পরিবেশে শিশুদের রাখা ও বেশি বেশি পানি পান করাতে হবে। সচেতনতার বিকল্প কিছু নেই। তিনি আরও জানান, গরমে বাড়ছে অস্বস্তি। কড়া রোদ ও আবহাওয়ার কারণে মানুষকে নানা ধরণের অসুখ-বিসুখে বিপর্যস্ত করছে। সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে জ্বর, হিটস্ট্রোক, পেটের অসুখ, ত্বকের সমস্যায়। এছাড়া গরমে ঘাম প্রচুর হয়। ঘাম হলে শরীর পানিশূন্য হয়ে যায়। পানিশূন্যতা শরীরকে দুর্বল করে তোলে।  রক্তচাপ কমে যায়। অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে কেউ কেউ। এমনকি ক্ষেত্র কিডনিও আক্রান্ত হতে পারে। তাই প্রচুর পানি ও পানি জাতীয় খাবার খেতে হবে। বেশি বেশি ডাবের পানি গরমে মানুষকে সুস্থ রাখতে পারে।

যশোর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালাম জানান, প্রচণ্ড তাপদহের কারণে গত ৫ জুন থেকে ৯ জুন পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই গরমে শিশু শিক্ষার্থীদের বেশি অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

যশোর শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. বিশ্বাস শাহীন আহমেদ সাক্ষরিত পত্রে জানানো হয়েছে তীব্র গরমের কারণে বৃহস্পতিবার  মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮ম ও ৯ম শ্রেণির অর্ধবার্ষিকী ও দশম শ্রেণির প্রাক নির্বাচনী পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।

যশোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক মঞ্জরুল হক জানান, অব্যাহত খরতাপের কারণে কিছু কিছু সবজি শুকিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় চাষিদের নানাভাবে পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করা হচ্ছে।

যশোর বিমান বন্দর সংলগ্ন আবহাওয়া অফিস বলছে, যশোরের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এই তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে আরও কয়েকদিন।