কাঠগড়া বাওড় ব্যবস্থাপকের বিরুদ্ধে ৩৫ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

এখন সময়: শনিবার, ২০ এপ্রিল , ২০২৪, ০৫:৩৯:০৫ পিএম

আলমগীর কবির, কোটচাঁদপুর (ঝিনাইদহ) : বিল বাঁওড় মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্প যশোরের অধীন সরকারি কাঠগড়া বাওড়ের ব্যবস্থাপক দেবব্রত কবিরাজের বিরুদ্ধে মাছ বিক্রির অর্থ রাজস্ব খাতে জমা না দিয়ে প্রায় ৩৫ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে এ বাঁওড়ে মাছ ধরা শুরু হয় গত বছরের ১৮ নভেম্বর। প্রথমধাপে মাছ ধরা শুরুর মাত্র ৫ সপ্তাহের মধ্যেই কচাল ও কোমর থেকে ৫২ লক্ষ টাকার মাছ বিক্রি করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী বিক্রির ৪০ শতাংশ অর্থ মৎস্যজীবীরা বুঝে পেলেও সরকারি অংশের রাজস্বের ৬০ শতাংশ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা পড়েনি। ব্যবস্থাপক নিজ খেয়ালখুশিমত ৫ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত মাত্র ১১ লক্ষ ২২ হাজার টাকা জমা দেখান। বর্তমান বাঁওড় ব্যবস্থাপক দেবব্রত কবিরাজ গত বছরের ১৪ অক্টোবর এ বাঁওড়ে যোগ দেন। আগের ব্যবস্থাপক হরিণাথ কুমার দেবনাথের রেখে যাওয়া মাছ তিনি চলতি মৌসুমে ধরতে শুরু করেন।

স্থানীয় মৎস্যজীবী ও বিভিন্ন সূত্রে জানায়, ব্যবস্থাপক নিজ ইচ্ছামত রাতের আঁধারে ধরা মাছ বাঁওড় সংলগ্ন মহেশখোলা সাধনের বাড়িসহ বিভিন্ন স্থান থেকে তুলেছেন। অথচ তিনি সরকার নির্ধারিত মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে মাছ আনেনি। কারণ হিসাবে তিনি জানান, বাঁওড়ে অতিরিক্ত পট (কচুরিপানা) থাকার কারণে নৌকা অবতরণ কেন্দ্রে আনা সম্ভব হয়নি। কিন্তু সরেজমিনে তার এ বক্তব্যের সাথে কোন মিল পাওয়া যায়নি। নিজ উদ্দেশ্য হাসিল করতেই তিনি বাঁওড়ের পছন্দের স্থান থেকে মাছ তুলে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেছেন। মৎস্যজীবীদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, মৌসুম শুরুর প্রথম ধাপে ৫ সপ্তাহে ৫২ লক্ষ টাকার মাছ বিক্রি করা হয়। তারা আরো জানান, তাদের পাওনা ৪০ শতাংশ ২০ লক্ষ ৮০ হাজার টাকাও তারা বুঝে পেয়েছেন। কিন্তু বাকী ৩১ লক্ষ টাকার মধ্যে ব্যবস্থাপক মাত্র সরকারি কোষাগারে জমা দেখান ১১ লক্ষ ২২ হাজার টাকা। তার কাছে থাকা ১৯ লক্ষ ৯৮ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তীতে মাছ ধরা অব্যাহত থাকলেও বিক্রির সে টাকাও তিনি নিজ হেফাজতে রাখেন। অন্যদিকে বাওড়ের ১২টি পুকুরে পোনা তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৪ লক্ষ ২৮ হাজার টাকা সরকারি বরাদ্দ পান। বরাদ্দের এ টাকাও তিনি ভ‚য়া বিল ভাউচার দিয়ে তুলে নিয়ে নয় ছয় করেছেন এমন অভিযোগও রয়েছে। তবে বাঁওড় ব্যবস্থাপক এ অর্থে তৈরি করা সাড়ে সাত মেট্টিকটন পোনা বাওড়ে অবমুক্ত করার দারি করেন। ৩৮৫ একর আয়তনের এ বাঁওড়ে সরকারিভাবে বাঁওড় ম্যানেজারসহ ৬ কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ থাকলেও বর্তমানে ব্যবস্থাপকসহ ১ জন ওয়াচম্যান রয়েছেন। অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীর পদ খালি থাকায় তিনি এককভাবেই সবকিছু করছেন। বাঁওড় পাশ্ববর্তী স্থানীয়রা জানান, মাছ ধরা হলে ব্যবস্থাপক এখানে আসেন। তাছাড়া নিয়মিত তিনি অফিসও করেন না। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী স্থানীয় ভোক্তাদের কাছে মাছ বিক্রির পর যা অবশিষ্ট থাকবে তা বাজারে পাঠানোর কথা। কিন্তু প্রায় শতভাগ মাছের গ্রেড প্রজাতি নির্ণয় ও ওজন না করে পছন্দের আড়তে বিক্রি  করেছেন। যে কারণে স্থানীয় ভোক্তারা মাছ ক্রয় থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এ বাঁওড়ে রুই, কাতল, মৃগেল, সিলভার, কমন কার্প, মিরর কার্প মাছ চাষ হয়। এখানে বাঁওড় থেকে ধরা মাছের গ্রেড ও প্রজাতি দর হার পরিবর্তন করে কাগজ কলমে ৯০ শতাংশ মাছই সিলভার দেখানো হয়। জমা দেয়া রাজস্বে প্রতি কেজি মাছের মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৭৫ টাকা। যা নিতান্তই হাস্যকর! চলতি ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে বাওড়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩৬ মেট্টিকটন। যা টাকার অংকে মাত্র ১৬ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। মৎস্য বিভাগে দেয়া এ বিতর্কিত লক্ষ্যমাত্রার সুবাদেই বাওড় ব্যবস্থাপক খেয়াল খুশিমত সরকারের রাজস্ব বঞ্চিত করে নিজে টাকার পাহাড় গড়েছেন। তবে তার চেয়ার ঠেকাতে নাকি রাজস্ব তছরূপের টাকা কর্তা ব্যক্তিসহ বিভিন্ন খাতে ভাগবাটোয়ারা করতে হয়। মৎস্যজীবীরা আরো জানান, চলতি বছরে ২৫ ফেব্র“য়ারি থেকে বাঁওড়ের দ্বিতীয় ফিশিং চলাকালে জেলেদের ৪০ শতাংশ পাওনা পরিশোধ করে তিনি ৪ লক্ষ ৪৪ হাজার ৪৪৫ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ৭ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া তৃতীয় দফা ফিশিং থেকেও তিনি ৭ লক্ষ ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এই নিয়ে তিন দফায় তিনি মাছ বিক্রির টাকা থেকে ৩৫ লক্ষ ৯৬ হাজার ৮শ’ ৯০ টাকা আত্মসাৎ করেন। অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি সর্বমহলে জানাজানির পরও তিনি রয়েছেন বহাল তবিয়তে। 

মৎস্যজীবী ও স্থানীয়দের অভিযোগ প্রথম দফায় ৫ সপ্তাহের ফিশিংয়ে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে। প্রথম দফায় মাছ বিক্রি হয় ৫২ লক্ষ টাকা। যা টার্গেট পূরণ করেও ১৯ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। অভিযোগ রয়েছে ব্যবস্থাপক কর্তা ও শীর্ষ ব্যক্তিদের চাহিদা মেটাতে ২য় ও ৩য় দফায় ফিশিং করান। এমনি করে খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠানে পুকুর চুরি অব্যাহত থাকলেও দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। আহরণ মৌসুম চলাকালে তার বিরুদ্ধে স্থানীয় জেলে ও সচেতন মহলের অভিযোগের শেষ ছিল না। তারা বিষয়টি প্রকল্প পরিচালককে জানালেও তিনি কোন অভিযোগই আমলে নেননি। মৌসুমের শেষ দিকে ব্যবস্থাপক পুকুরের পোনা মাছ নিধনে মেতে ওঠেন। অথচ সরকারি নির্দেশনা রয়েছে পুকুরে পোনা উৎপাদন করে বাঁওড়ে ছাড়া। কিন্তু তিনি ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে বাওড়ে পোনা মজুদ না বাড়িয়ে চোরাই পথে বিক্রি করেছেন। গত ২৮ মে ৪শ’ ২০ কেজি পোনা ৪২ হাজার টাকা, ১০ জুন ৩শ’ ৮০ কেজি ৩৬ হাজার টাকা, ৫ জুলাই ১শ’ ১০ কেজি ১৩ হাজার ২শ’ ১৫ টাকা ও সর্বশেষ ৭ জুলাই ৪শ’ ১০ কেজি পোনা মাছ ৪২ হাজার ৭শ’ ৩৫ টাকায় বিক্রি করেন। এ সমস্ত পোনা মাছ চৌগাছা বাজারের আনোয়ারের আড়তে বিক্রি করা হয়েছে বলে জানা যায়। ব্যবস্থাপক শুধু মাছ বিক্রি ও বরাদ্দের টাকা আত্মসাৎ করেই ক্ষ্যান্ত হননি। তিনি ঝড়ে পড়া বাঁওড় চত্বরে দু’টি বড় মেহেগুনি গাছ গত ১ আগস্ট এক গার্ডের মাধ্যমে মিলে সয়িং করার জন্য পাঠান। কিন্তু বিষয়টি প্রকল্প পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) কে জানালে তার নির্দেশে কাঠ ফেরত এনে স্টোর রুমে রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে বাওড় ব্যবস্থাপক দেব্রবত কবিরাজের সাথে কথা বললে তিনি পোনা ও মাছ বিক্রির টাকা আত্মসাতের ব্যাপারে অস্বীকার করেন। তবে পোনা বিক্রির প্রভিশন আছে বলে তিনি দাবি করেন। এ ব্যাপারে যশোরের প্রকল্প পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) আনিচুর রহমানের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করতে গেলে দু-এক লাখ টাকা এদিক সেদিক হতে পারে। তবে যে টাকার কথা বলা হচ্ছে তা অনেক বেশি। তিনি বিষয়টি দেখবেন বলেও নিশ্চিত করেন।