Ad for sale 100 x 870 Position (1)
Position (1)

যশোরে ভুয়া ডাক্তারের রাজত্ব

এখন সময়: বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর , ২০২৫, ০৩:৫৬:১১ এম

বিল্লাল হোসেন : আব্দুল আলিম (৫০) ডিগ্রিধারী চিকিৎসক নন। অথচ মাসের পর মাস যশোর শহর ও চৌগাছা উপজেলা শহরে দিব্যি ডাক্তার পরিচয়ে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছিলেন। গত ২২ অক্টোবর আদর্শ মেডিকেল হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে তার প্রতারণা ফাঁস হয়। চৌগাছা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তাসমিন জাহান অভিযানটি পরিচালনা করেন। এসময় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) অনুমোদিত নিবন্ধনপত্র দেখাতে না পারায় ভুয়া চিকিৎসক আব্দুল আলিমকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা। তিনি যশোর শহরের শংকরপুরের মৃত আবু বক্কারের ছেলে। এর আগে গত ২৩ জুলাই চৌগাছার রায়হান হোমিও হলে অভিযান চালিয়ে জহির রায়হান (৩৭) নামে আরেক ভুয়া চিকিৎসককে এক হাজার টাকা ও ১৫ দিনের কারাদন্ড প্রদান করে ভ্রাম্যমান আদালত। আব্দুল আলিম ও জহির রায়হানের মত আরও অনেক ভুয়া ডাক্তারের রাজত্ব চলছে যশোরে। তাদের খপ্পরে পড়ে মানুষ প্রতারিত হচ্ছেন। আসল চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্র, সাইনবোর্ড ও ভিজিটিং কার্ডে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসির) নিবন্ধন নম্বর উল্লেখ না করায় ভুয়ারা বহাল তরিয়তে কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। ভুয়া চিকিৎসকদের দমনে উপজেলা প্রশাসন মাঝে-মধ্যে অভিযান চালালেও অজ্ঞাত কারণে সিভিল সার্জন অফিস নিরব রয়েছেন।

জানা গেছে, ভুয়া ডিগ্রিধারীদের শনাক্ত করতে চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র, ভিজিটিং কার্ড, নামফলক ও সাইনবোর্ডে তাদের নিবন্ধন নম্বর উল্লেখের পদক্ষেপ গ্রহণ করে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসির)। এ ব্যাপারে ২০১৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিএমডিসি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নির্দেশনা জারি করেন। কিন্তু যশোরের চিকিৎসকরা এ নির্দেশনা মানছেন না। যশোর জেলার প্রায় বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দায়িত্বরত পালন করা চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র, ভিজিটিং কার্ড ও সাইনবোর্ডে বিএমডিসির নিবন্ধন নম্বর উল্লেখ নেই। ফলে আসল নকল চিকিৎসকদের চেনার কোন উপায় থাকছেনা। এ সুযোগে ভুয়া ডিগ্রিধারীরা চিকিৎসাসেবার নামে প্রতারণা করে চলেছেন। সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে হাজার হাজার টাকা লুফে নিচ্ছেন তারা। অথচ সঠিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা।

সূত্র জানায়, আসল চিকিৎসকরা বিএমডিসির নিবন্ধন উল্লেখ না করার সুযোগ নিচ্ছে ভুয়ারা। এমবিবিএস পাস না করেও অনেকে নামের আগে ডাক্তার লিখে বড় বড় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিচ্ছে চিকিৎসাসেবার নামে প্রতারণা করছেন। মাঝে মধ্যে প্রশাসন ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে ভুয়া ডাক্তারদের জেল-জরিমানা করেন।

চলতি বছরের গত ২৩ অক্টোবর যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল চত্বর থেকে নীলা মল্লিক নামে এক ভুয়া ডাক্তার আটক হয়। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসক-কর্মচারীরা তাকে আটকের পর তাকে পুলিশে সোপর্দ করে। ভুয়া ডাক্তার নীলা মল্লিক বাগেরহাট সদর থানার জাহিদ মল্লিকের মেয়ে। বর্তমানে তিনি যশোরের মণিরামপুর উপজেলার ভরতপুরে বসবাস করেন।

গত ৭ জুলাই জেনারেল হাসপাতাল থেকে আব্দুর রহিম রাকিব নামে আরেক ভুয়া ডাক্তার আটক হয়।  তিনি ডাক্তার পরিচয়ে যশোর শহরের পুরাতন কসবার বাসিন্দা সানজিদা খাতুনের কাছ ৫০০ টাকা হাতানোর পর পুলিশ বর্হিঃবিভাগ থেকে তাকে আটক করে। আব্দুর রহিম যশোর শহরের শংকরপুর বাস টার্মিনাল এলাকার মুজিবুর রহমানের ছেলে। ভুয়া ডাক্তার নীলা মল্লিক ও আব্দুর রহিম রাকিবের গায়ে চিকিৎসকের সাদা এপ্রোন পরা ছিল।

গত ১০ এপ্রিল যশোরের চৌগাছা উপজেলা শহরের পল্লবী হাসপাতালে অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেখানে ডাক্তার পরিচয়দানকারী শেখর চন্দ্র দেবনাথকে চ্যালেঞ্জ করা হয়। এ সময় তিনি ডিগ্রিধারী কোনো কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হন। ফলে ভুয়া ডাক্তার প্রমাণিত হলে ভ্রাম্যমাণ আদালত ১ লাখ টাকা জরিমানা করেন। এর আগে জাহিদুর রহমান নামে এক ভুয়া  চিকিৎসকের ২ হাজার ব্যবস্থাপত্র উদ্ধার করে আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটে।

গত ২০ মার্চ যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা শহরে উষা চিকিৎসাকেন্দ্রে অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে ধরা পড়ে ভুয়া চিকিৎসক সাধন কুমার দাস। তিনি নামের আগে ডাক্তার লিখে রোগীর চিকিৎসা দিলেও বৈধ কোন কাগজপত্র দেখাতে না পারায় সাধন কুমার দাসকে এক লাখ টাকা জরিমানা ও চিকিৎসালয় সিলগালা করা হয়।

গত ৩ ফেব্রুয়ারি যশোরের কেশবপুর উপজেলার কপোতাক্ষ সার্জিক্যাল ক্লিনিকে এক রোগীর অপারেশন করাকালীন ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ধরা পড়েন ভুয়া চিকিৎসক ফিরোজ কবির। এ সময় তাকে দুই মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। তিনি ডিগ্রিধারী না হয়েও ডাক্তার পরিচয়ে তিনি রোগীর অপারেশন করতেন আবার দিতেন চিকিৎসাসেবা।

২০২২ সালের ৯ জুন যশোর শহরের ঘোপ নওয়াপাড়া রোডে অবস্থিত পিয়ারলেস ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালিয়ে ভ্রাম্যমান আদালত হাবিবুর রহমান নামে একজন ভুয়া ডাক্তারকে আটক করে। তিনি নামে আগে ডাক্তার লিখে প্রতি রোগীর কাছ থেকে ব্যবস্থাপত্রের ভিজিট ৩০০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিলেন। এমবিবিএস ও বিডিএস ডিগ্রীধারী বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশনকৃত কাগজপত্র দেখাতে না পারায় তাকে ১৫ দিনের জেল ও ১ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।

এছাড়া বিগত দিনে ভুয়া ডিগ্রি ব্যবহার করে চিকিৎসাসেবার নামে রোগীদের সাথে প্রতারণার অভিযোগে ভ্রাম্যমান আদালত ৬ জনকে আটক করেন। তারা হলেন যশোর শহরের আর এন রোডের রাশেদ হেলথ কেয়ারের মালিক রাশেদ পারভেজ ফুলু, হেলথ প্লাস মেডিকেল এইডের আসাদুজ্জামান,তার স্ত্রী বিলকিছ বানু, এমকে রোডের পাইলস কিউর সেন্টারের এইচএসএম আব্দুর রব, ধর্মতলা মোড়ের নিলিমা ডেন্টাল কেয়ারের শরৎ শিকদার, ইতু ডেন্টাল কেয়ারের ফয়জুল ইসলাম। তারা এমবিবিএস পাশ না করেও নামের আগে ডাক্তার লিখে বড় বড় সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে প্রতারনা করছিলেন।

এদিকে, অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় ভুয়া ডাক্তার জেল-জরিমানার শিকার হলেও কর্মকান্ড থেমে নেই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ডাক্তার সেজে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে চলেছেন। ঝিকরগাছায় উপজেলার ফেমাস মেডিকেল এন্ড ডায়াগনস্টিকে চিকিৎসক পরিচয়ে শরিফ উদ্দিন রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়াসহ সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারও করছেন। গত ১৬ সেপ্টেম্বর শরিফ উদ্দিনের ত্রুটিপূর্ণ অস্ত্রোপচারে টেবিলে মারা যান শিহরদাহ সরদারপাড়া গ্রামের ইয়ানুর রহমানের স্ত্রী সোহানা বেগম (১৯)।  বাঘারপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রোডে শুভদ্রা মেডিকেল হলে প্রভাত কুমার সমাদ্দার  ডাক্তার পরিচয়ে রোগীদের পাইলস অস্ত্রোপচার করছেন। তিনি গত ১৬ অক্টোবর তিনি চৌগাছা উপজেলার কাবিলপুর গ্রামের স্বামী পরিত্যক্তা সেলিনা বেগমের পাইলস অস্ত্রোপচার করেন। অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসা বাবদ হাতিয়ে ১০ হাজার টাকা। ভুয়া ডাক্তার প্রভাত কুমার সমাদ্দারের অপচিকিৎসায় সেলিনা বেগমের জীবন এখন সঙ্কটাপন্ন।  যশোর সদর উপজেলার  হৈবতপুর ইউনিয়নের সাতমাইল-বারীনগর বাজারের শাহবাজপুর রোডে মাত্র ৫ গজের ব্যবধানে শাহআলম ওরফে বাবুল বারীনগর ডেন্টাল, আলমগীর কবীর আজাদ ডেন্টাল কেয়ার ও ইকরামুল হোসেন হালিমা ডেন্টাল কেয়ার প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানে নিজেরাই ডাক্তার সেজে রোগীর দাঁত তোলা, বাঁধানো, ওয়াশ, পুটিং, ক্যাপ ও রুট ক্যানেল করছেন। আলমগীর কবীর আজাদ, ইকরামুল হোসেন ও শাহ আলম ওরফে বাবলু কেউ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নন। সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের সঠিকভাবে তদারকি ব্যবস্থা ও জবাবদিহিতা না থাকায় ডাক্তাররা ব্যবস্থাপত্র, সাইনবোর্ড ও ভিজিটিং কার্ডে বিএমডিসির নিবন্ধন নম্বর উল্লেখ করছেন না। এতে ভুয়া ডাক্তাররা রাজত্ব করছেন।

যশোরের সিভিল সার্জন ডা. মাসুদ রানা জানান, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে সাইনবোর্ড ও ভিজিটিংকার্ডে বিএমডিসির নিবন্ধন নম্বর উল্লেখ করার ব্যাপারে সরকারিভাবে নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ চিকিৎসক নির্দেশনা মানছেন না এটা তিনিও অবগত। বিএমডিসি নির্দেশনা দিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সিভিল সার্জন আরও জানান, এমবিবিএস ও বিডিএস ডিগ্রীধারী বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশনকৃতরা ছাড়া কেউ নামের আগে ডাক্তার লিখতে পারবেন না। ভুয়া ডাক্তার দমনে স্বাস্থ্য বিভাগ সোচ্চার রয়েছে।

Ad for sale 100 x 870 Position (2)
Position (2)
Ad for sale 225 x 270 Position (3)
Position (3)
Ad for sale 225 x 270 Position (4)
Position (4)