নরমাল ডেলিভারির উপর গুরুত্ব

মণিরামপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৯৪ ডেলিভারির মধ্যে নরমাল ২২৫

এখন সময়: বুধবার, ২৪ এপ্রিল , ২০২৪, ০৫:৫৯:৪৬ এম

নূরুল হক, মণিরামপুর : গর্ভবতী মায়ের সিজারিয়ান অপারেশন (অস্ত্রোপচার) এর মাধ্যমে ডেলিভারির খরচ মেটাতে যখন অধিকাংশ মধ্যবিত্ত অথবা নি¤œ-মধ্যবিত্ত অভিভাবকরা দিশেহারা-তখন যশোরের জেলার মণিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গুরুত্বারোপ করেছেন বিনামূল্যে নরমাল ডেলিভারির দিকে। তার ওপর নরমাল ডেলিভারির প্রতি আগ্রহ বাড়াতে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। ফলে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নরমাল ডেলিভারির সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর নরমাল ডেলিভারিতে যেমন খুশি প্রসূতি মা, তেমনি তাদের অভিভাবকরা।

জানাযায়, বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম উপজেলা মণিরামপুরে মোট জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ৬ লাখ। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গাইনি বিশেযজ্ঞ (সার্জারি) চিকিৎসক পোস্টিং না থাকায় গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে বিশেষ করে ক্রিটিক্যাল (জটিল) রোগিরা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিল। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বেসরকারি ক্লিনিক মালিকরা তাদের প্রতিনিধিদের (দালাল) মাধ্যমে বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের গর্ভবতী মায়েদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করান। তবে অভিযোগ রয়েছে কারণে-আকারণে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ অধিকাংশ গর্ভবতীকে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে ডেলিভারি করান। আর এ জন্য গর্ভবতীর অভিভাবককে ক্লিনিকের ধার্য্যকৃত টাকা পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হয়। প্রতি সিজারিয়ান ডেলিভারিতে গুনতে হয় আট থেকে ৩০ হাজার টাকা।

বর্তমান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিশেবে ডাক্তার তন্ময় বিশ্বাস মণিরামপুরে যোগদান করেন চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি। তিনি জানান,  যোগদানের পর থেকে অধ্যাবধি পর্যন্ত এখানে (স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স) কোন গাইনি বিশেযজ্ঞ চিকিৎসক (সার্জারি) পোস্টিং দেয়া হয়নি। ফলে গর্ভবতী মায়েদের সেবা দেয়ার জন্য যশোরের সিভিল সার্জনের প্রচেষ্টায় কেশবপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গাইনি বিশেযজ্ঞ (সার্জারী) ডাক্তার আয়শা আক্তারকে ডেপুটেশনে সপ্তাহে তিনদিন এখানে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সেই থেকে সপ্তাহে রোব, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী ডেলিভারী (সিজার ও নরমাল) করানো হচ্ছে।

 ডা. তন্ময় বিশ্বাস জানান, আমাদের গ্রামাঞ্চলের মায়েদের অসচেতনতার কারনেই মূলত: ডেলিভারির সময় ক্রিটিক্যাল (জটিল) পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যে কারণে শেষ পর্যন্ত সিজারিয়ান (অস্ত্রোপচার)এর মাধ্যমে ডেলিভারির প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। বিষয়টি উপলদ্ধি করতে পেরে তিনি গুরুত্বারোপ করেন নরমাল ডেলিভারির ওপর। এ জন্য গাইনি বিশেযজ্ঞ ডা. আয়শা আক্তারের নেতৃত্বে এ্যানেসথেসিয়া (অবশ) ডা. খালেদুজ্জামান মুজাহিদ, আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. অনুপ কুমার বসু ও  ধাত্রীবিদ্যায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাঁচজন মিডওয়াইফের সমন্বয়ে গঠন করা হয় একটি ডেলিভারী টিম। মূলত: এ টিমের সদস্য মিডওয়াইফরা তালিকা অনুসারে গর্ভবতীদের ফোন করে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এনে নিয়মিত চেকআপ করেন। যে সব গর্ভবতীর অবস্থা একটু ক্রিটিক্যালের লক্ষন পাওয়া যায় তাদেরকে গাইনি বিশেযজ্ঞ ডা. আয়শা আক্তারের কাছে পাঠানো হয়। এ ক্ষেত্রে ডাঃ আয়শা আক্তার তাদের নিয়মিত চিকিৎসা দিয়ে স্বাভাবিক করেন। ফলে অধিকাংশ গর্ভবতীকে নরমাল ডেলিভারি করানো সম্ভব হয়।

ডা. আয়শা আক্তার জানান, নরমাল ডেলিভারির জন্য গর্ভবতীকে যেমন সচেতন থাকতে হবে, তেমনি চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতাও থাকতে হবে। তাহলে দিন দিন নরমাল ডেলিভারির প্রতি মায়েদের আগ্রহ বাড়বে।

ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মহিলা ওয়ার্ডের ছয়টি বেডের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে প্রসুতি বিভাগ। এ ছাড়াও নির্মাণ করা হয়েছে কেএমসি (ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার ইউনিট) ওয়ার্ড। ডা. তন্ময় বিশ্বাস জানান, গাইনি বিশেযজ্ঞের নেতৃত্বে ডেলিভারি টিম গঠনের কয়েক মাসের মধ্যে এ পর্যন্ত ডেলিভারি করা হয়েছে ২৯৪টি। এর মধ্যে নরমাল হয়েছে ২২৫ টি এবং সিজারিয়ান (অস্ত্রোপচার) এর মাধ্যমে হয়েছে ৬৯ টি। তার ওপর নরমাল ডেলিভারির প্রতি আগ্রহ বাড়াতে ইতোমধ্যে প্রসূতি মা ও নবজাতককে দেয়া শুরু হয়েছে বেবিসেটসহ বিশেষ উপহার। ফলে দিন দিন নরমাল ডেলিভারির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কথা হয় উপজেলার দোনার গ্রামের কৃষক রাসেল হোসেনের স্ত্রী প্রসূতি মা তানজিলা খাতুনের সাথে। তিনি  বলেন, গ্রামের এক ডাক্তার (পল্লী চিকিৎসক) বলেছিলেন সিজার করা লাগতে পারে। সেই থেকে অজানা ভয়ের ভেতর ছিলাম। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তির পর মিডওয়াইফ আছিয়া, টুম্পা ও রিপা আমাকে সাহস জুগিয়ে কয়েকদিন ধরে নিয়মিত পরিচর্যা করায় নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। তার ওপর বেশি খুশি হয়েছি আমার একটা ছেলে সন্তান হওয়ায়। 

জুড়ানপুর গ্রামের সোহাগ হোসেনের স্ত্রী প্রসূতি মা মরিয়ম বেগম জানান, প্রথমে তিনি খুব ভয় পেয়েছিলেন নরমাল ডেলিভারিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডাক্তারদের প্রচেষ্টায় সফল হয়েছে।

যশোরের সিভিল সার্জন ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস বলেন, আমরা সিজারের (অস্ত্রোপচার) পরিবর্তে নরমাল ডেলিভারির দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। ফলে মণিরামপুরে গাইনি বিশেযজ্ঞ চিকিৎসক পোষ্টিং দিতে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার অবহিত করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে অচিরেই এ সমস্যার সমাধান হবে।