ইসি গঠনের বিল পাস : সার্চ কমিটিতে থাকবেন একজন নারী

এখন সময়: বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ , ২০২৪, ০৮:১০:৫২ পিএম

 

স্পন্দন ডেস্ক : অনুসন্ধান কমিটিতে রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুই ‘বিশিষ্ট নাগরিকের’মধ্যে একজন নারীকে রাখার বাধ্যবাধকতা রেখে বহুল আলোচিত নির্বাচন কমিশন গঠন আইনের প্রস্তাবে সায় দিয়েছে জাতীয় সংসদ। পাস হওয়া বিলে সার্চ কমিটির কাজ ১৫ কার্য দিবসের মধ্যে শেষ করতে বলা হয়েছে, যা খসড়ায় ১০ কার্যদিবস ছিল।

আলোচিত ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে পাসের প্রস্তাব করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পরে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।

এর আগে বিলের ওপর দেওয়া জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনী প্রস্তাবগুলোর নিষ্পত্তি করেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। জাতীয় পার্টি, বিএনপি, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির সংসদ সদস্যরা বিলের ওপর এসব প্রস্তাব দেন।

প্রথমে বিলের নাম ছিল, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল’। সংসদে সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে এখন নাম হয়েছে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল’।

ওয়ার্কাস পার্টির রাশেদ খান মেনন সার্চ কমিটিতে দুই জন বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে একজন নারী রাখার প্রস্তাব করেন। আইনমন্ত্রী সেই প্রস্তাব গ্রহণে স্য়া দিলে, সংসদ তা ভোটে গ্রহণ করে।

অর্থাৎ, ইসি গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে নাম সুপারিশের জন্য যে সার্চ কমিটি থাকবে, সেখানে একজন নারী থাকবেন।

বিলে বলা ছিল রাষ্ট্রপতি ছয় সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন, যার সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারক।

সদস্য হিসেবে থাকবেন- প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাই কোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত দুই জন বিশিষ্ট নাগরিক।

এখন রাষ্ট্রপতির মনোনীত ওই দুজন বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে একজন নারী রাখার বিধান যুক্ত হল।

বিলে সার্চ কমিটির কাজ ১০ কার্যদিবস করার বিধান রাখা হয়েছিল। সেটি এখন ১৫ কার্যদিবস করা হয়েছে। জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমামের এ সংক্রান্ত সংশোধনী সংসদ গ্রহণ করে।

জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাবগুলো পাসের সময় জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা সার্চ কমিটিতে সংসদের প্রতিনিধিত্ব দাবি করেন। বিলটির নানা দিকের সমালোচনা করেন তারা।

এছাড়া বিলের ওপর বিভিন্ন শব্দ ও ছোটখাট কয়েকটি সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সংসদ সদস্যদের ৬৪টি সংশোধনী প্রস্তাবের মধ্যে ২২টি আইনমন্ত্রী গ্রহণ করেন, যা সংসদের ভোটে পাস হয়।

সংশোধনীগুলো গ্রহণের সময় আইনমন্ত্রী বলেন, এতগুলো সংশোধনী আগে কখনও গ্রহণ করা হয়নি।

বিলটি পাসের সময় জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা অভিযোগ করেন, খসড়া আইনটি ‘তড়িঘড়ি করে’ আনা হয়েছে।

এর জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, “গত ১৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপ করে। যারা সংলাপে যায়নি এবং গিয়েছেন তারা সবাই আইনের কথা বলেছেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আইনের বিষয়ে তার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। আমরা তড়িঘড়ি করিনি। এ আইনের কথা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। ২০১৭ সালেই এই আইনের কথা উঠেছিল।”

এই বিল নিয়ে সংসদের ভেতরে ও বাইরের সমালোচনার জবাব দেন আইনমন্ত্রী। সাবেক সিইসি এটিএম শামসুল হুদা এবং সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) তৈরি করা এ সংক্রান্ত আইনের খসড়া থেকে পড়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ওই দুটির সঙ্গে সরকারের আনা বিলের মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই।

এখন রাষ্ট্রপতি এই বিলে সই করলে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে। প্রথমবারের মত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে আইন পাবে বাংলাদেশ।

দেশের পরবর্তী নির্বাচন কমিশন এই আইনের অধীনেই গঠন করা হবে, যদিও বিলটি নিয়ে রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের নানামুখী সমালোচনা রয়েছে।

সংসদীয় কমিটির সুপারিশসহ বিল পাস

গত রোববার বিলটি সংসদে উত্থাপন করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পরে বিলটি পরীক্ষা করে সাত দিনের মধ্যে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।

বুধবার দুটি পরিবর্তনের সুপারিশসহ প্রতিবেদন সংসদে তোলেন সংসদীয় কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার।

সংসদে উত্থাপিত বিলে সিইসি ও কমিশনারদের যোগ্যতা সংক্রান্ত ৫(গ) ধারায় বলা ছিল, সিইসি ও কমিশনার হতে গেলে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা সরকারি বা বেসরকারি পদে তার অন্যূন ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

এই ধারায় সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা সরকারি বা বেসরকারি পদের পাশাপাশি ‘স্বায়ত্তশাসিত ও পেশায়’ যুক্ত করার সুপারিশ করেছিল সংসদীয় কমিটি। তা সংসদে গৃহীত হয়েছে।

এর ফলে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে এমন ব্যক্তিদের সার্চ কমিটি সুপারিশ করবে, যাদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা সরকারি বা বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত পদে বা পেশায় অন্যূন ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা আছে।

আর অযোগ্যতার ক্ষেত্রে ৬ (ঘ) ধারায় বলা ছিল, নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে সিইসি ও কমিশনার হওয়া যাবে না।

এখানে দুই বছরের কারাদণ্ড উঠিয়ে দিয়ে শুধু কারাদণ্ডের সুপারিশ করেছিল সংসদীয় কমিটি। অর্থাৎ, নৈতিকস্খলন ফৌজদারি অপরাধে যে কোনো মেয়াদের সাজা হলেই সিইসি বা কমিশনার হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগত্য হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এ সংশোধনী প্রস্তাবও সংসদ গ্রহণ করেছে।

কী হবে সার্চ কমিটির কাজ

সার্চ কমিটির (অনুসন্ধান কমিটি) কাজ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে।

আইনে বেধে দেওয়া যোগ্যতা, অযোগ্যতা অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে।

এ অনুসন্ধান কমিটি সিইসি ও কমিশনারদের প্রতি পদের জন্য দুই জন করে ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে। কমিটির গঠনের ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে জাম দিতে হবে।

সার্চ কমিটি সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনার পদে যোগ্যদের অনুসন্ধানের জন্য রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহ্বান করতে পারবে।

কারা থাকবেন সার্চ কমিটিতে

রাষ্ট্রপতি ছয় সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন, যার সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারক।

সদস্য হিসেবে থাকবেন-প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত দুই জন বিশিষ্ট নাগরিক। এই দুই বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে একজন হবেন নারী। 

তিন জন সদস্যের উপস্থিতিতে কমিটির সভার কোরাম হবে। আর কমিটির কাজে সাচিবিক সহায়তা দেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

সিইসি ও কমিশনারদের যোগ্যতা

সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে কাউকে সুপারিশের ক্ষেত্রে তিনটি যোগ্যতা থাকতে হবে

>> তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে।

>> ন্যূনতম ৫০ বছর বয়স হতে হবে।

>> কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা সরকারি বা বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত পদে বা পেশায় পদে তার অন্যূন ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

সিইসি ও কমিশনারদের অযোগ্যতা

সিইসি ও কমিশনার পদের জন্য ছয়টি অযোগ্যতার কথা বলা হয়েছে।

>> আদালত অপ্রকৃতিস্থ ঘোষণা করলে।

>> দেউলিয়া হওয়ার পর দায় থেকে অব্যাহতি না পেলে।

>> কোনো বিদেশি রাষ্ট্র্রের নাগরিকত্ব নিলে কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করলে।

>> নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে।

>> ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট-১৯৭৩ বা বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস) অর্ডার-১৯৭২ এর অধীনে কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে।

>> আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করছে না, এমন পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কর্মে লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে।

আইনের প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের সংবিধানে বলা আছে, সাংবিধানিক সংস্থা ইসিতে কমিশনার নিয়োগের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। আর তা একটি আইনের অধীনে হবে। এতদিন সেই আইন না হওয়ায় প্রতিবারই ইসি গঠনের সময় শুরু হয় বিতর্ক।

তা এড়াতে ২০১২ সালে নতুন কমিশন নিয়োগের সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান সার্চ কমিটি নামে একটি মধ্যস্থ ফোরাম তৈরি করেন, যেটি নিয়েও পড়ে বিতর্ক হয়।

এ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে একজন বিচারপতির নেতৃত্বে বিশিষ্ট কয়েকজন নাগরিকদের নিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করেন।

ওই সার্চ কমিটি সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার হতে যোগ্যদের নামের একটি তালিকা তৈরি করেন। সেই তালিকা থেকে একজন সিইসিসহ অনধিক পাঁচজন কমিশনার নিয়োগ দেন।

এরপর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ২০১৭ সালে সেই পদ্ধতিই অনুসরণ করেছিলেন। এবারও একই পদ্ধতিতে এগিয়ে যেতে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ শুরু করেন।

কিন্তু সংলাপে অংশ নেওয়া ২৫টি দলের প্রায় সবগুলো ইসি গঠনে স্থায়ী সমাধান হিসেবে আইন প্রণয়নের উপর জোর দেয়। আলোচনায় রাষ্ট্রপতিও এ বিষয়ে সম্মত হন বলে দলগুলোর নেতারা জানান। বিএনপিসহ সাতটি দল সংলাপে অংশ নেয়নি।

গত ১৭ জানুয়ারি বিকালে বঙ্গভবনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় ইসি গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির এবারের সংলাপ। তার আগে দুপুরে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ আইনের খসড়া অনুমোদন করা হয় অনেকটা আকস্মিকভাবে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গেল ডিসেম্বরে ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ শুরুর আগে বলেছিলেন, ‘সময়ের স্বল্পতার কারণে’ এবার আইন করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সংলাপে অংশ নেওয়া সব দলই আইন করার পক্ষে জোরালোভাবে দাবি জানালে পরিস্থিতি পাল্টে যায়।

অনেক আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে গত রোববার সংসদে বিল তোলেন আইনমন্ত্রী, যা বৃহস্পতিবার পাস হল।

কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি। এর আগেই নতুন কমিশন গঠন করতে হবে রাষ্ট্রপতিকে।

আইনটি সংসদে পাস হওয়াায় এখন গেজেট প্রকাশ, সার্চ কমিটি গঠন, তাদের সুপারিশ জমাসহ বাকি সব কাজের জন্য হাতে থাকছে ১৭ দিন সময়।