কুড়ানো গেন্ডারী আখের আগা লাগিয়ে সফলতা অনার্স পড়ুয়া সাগরের

এখন সময়: শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল , ২০২৪, ১০:৫৩:৪২ এম

জামির হোসেন, কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) : সাধারণত আখ কিনলে মানুষ আগা বাদ দিয়ে দেয়। এসব আগা বিক্রেতারা শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে। কালীগঞ্জের সাগর এক মাস ধরে এসব আগা রাস্তা থেকে কুড়িয়ে চাষের উপযোগী করেছেন। রোপন করেছেন ক্ষেতে। এতেই বাজিমাত করেছেন সাগর। 
সাগর ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের মহেশ্বরচাঁদা গ্রামের আশরাফুল ইসলামের ছেলে এবং ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। সরেজমিনে উপজেলার মহেশ্বরচাঁদা গ্রামের মাঠে গেলে দেখা যায়, সারা মাঠজুড়া ধান ক্ষেত। মাঝখানে রাস্তার ধারে সাগরের স্বপ্নের গেন্ডারী আখের ক্ষেত। সামনে এগুতেই দেখা মেলে লিকলিকে চেহারার একটি ছেলে কয়েকজন শ্রমিকের সাথে আখ ক্ষেতে কাজ করছে। সেখানে তার কষ্টে উৎপাদিত গেন্ডারীগুলো দাঁড়িয়ে আছে। আর ক্ষেতের একপাশে নষ্ট আখের স্তুপ পড়ে আছে। 
সাগর জানায়, তিনি হতদরিদ্র এক কৃষক পরিবারের সন্তান। মাঠে তাদের অল্প কিছু জমি আছে। কিন্ত ৫ সদস্যের সংসার চালাতে বাবাকে হিমশিম খেতে হয়। এছাড়াও তার লেখাপড়ার খরচ তো রয়েছেই। ফলে বাধ্য হয়ে বাবা ও তাকে অন্যদের ক্ষেতে কাজ করা লাগে। সংসারে লাগাতার অনটন। আবার টাকার কাজ কোনোদিন কথায় হয় না। তাই ভবিষ্যতে তার লেখাপড়ার খরচ যোগানো কোনো ভাবেই সম্ভব ছিল না। তাই করোনার দীর্ঘ ছুটিতে সে উৎপাদনমুখী কিছু করতে চেয়েছিল। কিন্ত সেখানেও তো টাকা দরকার। এ পর্যায়ে খালি হাতেই সে ঝুঁকি নিয়েছে। বুদ্ধি খাটিয়ে বাজারে অন্যের বিক্রি করা গেন্ডারী আখের আগা কুড়িয়ে তা প্রায় দেড় বিঘা জমিতে লাগানোর মাধ্যমে সফল হয়েছে। যা তার লেখাপড়ার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। 
সাগর আরো জানায়, বাজারে মানুষ যেখান থেকে আখ কিনে নিয়ে যায় আগার অংশ তেমন মিষ্টি না হওয়ায় কিছু অংশ কেটে ফেলে দেয়। এ আগালে কুড়িয়ে বাড়িতে সংরক্ষণ করেছে অত্যান্ত ধৈর্য্যরে সাথে। এভাবে এক মাসের অধিক সময় ধরে গেন্ডারী আখের আগা কুড়িয়েছেন। পরে তা সংরক্ষণ করে ক্ষেতে লাগিয়েছে। চারাগুলো চোখে ধরার মত হলে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে পরিচর্যা করতে হয়েছে। সাগর জানায়, ক্ষেত কিছুটা নিচু হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে ক্ষেতে পানি জমে বেশ ক্ষতি হলেও এ পর্যন্ত প্রায় ২ লক্ষাধিক টাকার আখ বিক্রি করা হয়েছে। আর ক্ষেতে এখনও যে আখ আছে তা বিক্রি করে যাবতীয় খরচ মেটানো যাবে। 
প্রতিবেশী কৃষক হেলাল উদ্দীন জানান, করোনার থাবায় যখন সবকিছু স্থবির হয়ে পড়েছিল। কলেজ বন্ধ থাকার দীর্ঘ সময়ে সাগর বাজারে বাজারে ঘুরে আগের আগা কুড়িয়ে তা ক্ষেতে চাষ করে ভালো ফলন পেয়েছে। যা অন্যদের জন্যও অনুকরণীয়। 
সাগরের বাবা আশরাফুল ইসলাম জানান, ৩৩ শতকের এক বিঘা জমিতে প্রায় ২৫শ’ থেকে ২৮শ’ চারা লাগে। সে হিসেবে দেড় বিঘা জমির জন্য প্রায় সাড়ে ৪ হাজার চারা লেগেছে। এর সবই প্রায় সাগরের কুড়ানো আগায় রোপণ হয়েছে। তারমধ্যে মাত্র ৩শ’ চারা প্রতিপিচ ২৫ টাকা দরে কিনতে হয়েছে। ওই মাঠে এর আগে কোনোদিন গেন্ডারী আখের চাষ হয়নি। সাগরই প্রথম। এ জাতের আখ সাধারণত ১২ থেকে ১৪ ফুট লম্বা হয়। মোটা হয় মাঝারি। আখ ভালো হলে একটা আখ ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়।  কড়া মিষ্টি হওয়ায় পাইকাররা ক্ষেত থেকেই আখ কিনে নিয়ে যাচ্ছে। 
নিয়ামতপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাজু আহম্মেদ রনি জানান,সাগর অত্যন্ত ন¤্র,ভদ্র ও শান্ত প্রকৃতির ছেলে। শত কষ্টের মধ্যেও সে লেখাপড়া চালিয়ে গেছে। অনেক শিক্ষার্থী অভাবের সম্মুখীন না হয়েও লেখাপড়া ধরে রাখতে পারে না। সে ক্ষেত্রে সাগর অন্যদের জন্য এক উজ্জল  দৃষ্টান্ত। 
কালীগঞ্জ উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা শিকদার মুহা,মোহায়মেন আক্তার জানান, আখ মুলত ২ ধরনের। একটিতে চিনি গুড় হয়। আর গেন্ডারী জাতের আখ মানুষ মুখে চিবিয়ে সুমিষ্ট রস গ্রহণ করে। বাজারে এগুলোর চাহিদাও বেশ। ভালো বীজের আখ লাগিয়েও অনেকে সন্তোষজনক ফল পায় না। অথচ কুড়ানো আখের আগা লাগিয়ে সাগর সকলকে চমকে দিয়েছে। 
তিনি আরও জানান, সাগরের গেন্ডারীর ক্ষেত তিনি দেখেছেন। নিচু জমি হওয়ায় ক্ষেত কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারপরও সে আগালে আখ লাগিয়ে বেশ লাভবান হবে। এক কথায় সাগরের চেষ্টাকে স্যালুট দিতে হয়।