Ad for sale 100 x 870 Position (1)
Position (1)

❒এক কেজি চিনি উৎপাদন খরচ ৫৪২ আর বিক্রি ১২৫ টাকা

লোকসানে জর্জরিত মোবারকগঞ্জ চিনিকল

এখন সময়: রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর , ২০২৫, ১১:৫৮:১০ এম

জামির হোসেন, কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) : মিলটিতে এক কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ হয়েছে ৫৪২ টাকা। আর প্রতি কেজি বিক্রি করেছে মাত্র ১২৫ টাকা। সে হিসাবে প্রতি কেজিতে লোকসান হয় ৪১৭ টাকা। এভাবেই শত শত কোটি টাকা লোকসানের রেকর্ড সৃষ্টি করেছে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে অবস্থিত দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান মোবারকগঞ্জ চিনিকল লিমিটেড। গত ২০২৪ মাড়াই মৌসুমে মিলটিতে লোকসান হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। তার আগের বছর ২০২৩ মাড়াই মৌসুমে লোকসান হয়েছে ৩৪ কোটি টাকা। এভাবে বছরের পর বছর কোটি কোটি টাকা লোকসান গোনাসহ প্রায় সাড়ে তিন শত কোটি টাকা ব্যাংকের দেনা মাথায় নিয়ে মিলটি জর্জরিত। গত মাড়াই মৌসুমে চিনিকলটি ৭০ হাজার টন আখ মাড়াই করে চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ হাজার ৯২০ মেট্রিক টন। চিনির আহরণের হার ধার্য ছিল ৫.৬ ভাগ। কিন্তু নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর লুটপাটের মহড়ায় মিলটি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। যে কারণেই লোকসানের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে।
মিল সূত্রে জানা যায়, বিগত দিনের শত শত কোটি টাকা দেনা মাথায় নিয়ে ২০২৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর মিলটির ৫৮তম আখ মাড়াই মৌসুম উদ্বোধন করা হয়েছিল। এ মাড়াই মৌসুমে মিলটি ২৫শত মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের বিপরিতে উৎপাদন করেছিল মাত্র ১৮শত ৭১ মেট্রিক টন। এবছরে মিলটিতে মোট ৭০ কোটি টাকা লোকসানের মধ্যে ছিল অপারেশনাল খাতে লস ৩৪ কোটি এবং ব্যাংক ঋণের (৩৫০ কোটি টাকার) সুদ বাবদ ৩৬ কোটি টাকা। মিলটিতে প্রতি বছরই বিপুল পরিমান লোকসানের পেছনে উল্লেখযোগ্য দিকগুলির মধ্যে রয়েছে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর নানা খাতে লুটপাটের মহড়া। মিলের কারখানা, গ্যারেজ পরিবহন রিপিয়ারিং ও ক্রয় বিক্রয় সহ হেন কোন খাত নেই যেখানে অনিয়ম থেমে আছে। এছাড়াও শ্রমিকদের অনেকেই কাজ না করে বেতন ভাতা ও অতিরিক্ত ওভার টাইম উত্তোলনসহ অদক্ষ জনবলে মিলটি ডুবে আছে। সব মিলিয়েই লুটপাটের মহোৎসব আর লাগামহীন অনিয়মের কবলে মিলটি লোকসান দিতে দিতে আজ দেনায় জর্জরিত।
জানা যায়, ১৯৬৫ সালে নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগিতায় ৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যায়ে কালীগঞ্জ শহর সংলগ্ন ২০৭ দশমিক ৯৩ একর জমির ওপর মোবারকগঞ্জ চিনিকলটি স্থাপিত হয়। মিলটির ২০ দশমিক ৬২ একর জমিতে কারখানা, ১০৭ একরে ইক্ষু খামার, ৩৮ দশমিক ২২ একরে কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের আবাসিক কলোনি, ১৮ দশমিক ১২ একরে সাবজোন অফিস ও আখ ক্রয় কেন্দ্র এবং ২৩ দশমিক ৯৮ একর জমিতে পুকুর রয়েছে। মিলটি প্রতিষ্ঠার পর ১৯৬৭-৬৮ সাল থেকে উৎপাদন কার্ষ্যক্রম শুরু করে। এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে মিলটি রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠানের হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
চিনিকলটিতে ১১’শ ৮৪ জন কর্মকর্তা কর্মচারীর পদ থাকলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন ৬৫৮ জন। দীর্ঘদিন ধরেই দক্ষ জনবল সংকটে ভুগছে মিলটি। আর বরাবরই কাচামাল হিসাবে আখের সংকট তো আছেই। প্রতি বছরে মিলটি ৬ মাস চালু থাকার কথা থাকলেও মাত্র দুই বা আড়াই মাস মিলের উৎপাদন কার্যক্রম চলে। এ অবস্থায় শ্রমিকদের ১২ মাসের বেতন ভাতা দিতেও মোটা অংকের টাকা গুনতে হয়।
মিল ম্যানেজমেন্ট ও শ্রমিকদের ভাষ্য, বৃটিশ আমলে মিলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজো আধুনিকায়নের মুখ দেখেনি। পুরনো আমলের যন্ত্রপাতি দিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম চলাতে প্রতি বছরই জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাড়ছে। এছাড়াও সরকারের ভ্যাট এবং ব্যাংক ঋণের সুদ পরিশোধে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়। এসব কারনেই মিলটি লোকসানে পড়ছে বলে তাদের ভাষ্য।
চিনিকলের আওতাধিন ঝিনাইদহের ছয় উপজেলা ও যশোরের দুটি উপজেলাসহ চিনিকলের ৮টি জোনের কৃষকদের অভিযোগ, মিলের কর্মকর্তা ও সিবিএ নেতাদের লাগামহীন দুর্নীতি, কর্তব্য অবহেলা ও অদক্ষ শ্রমিক কর্মচারীদের কারণে মিলটির তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। কালীগঞ্জ উপজেলার পুকুরিয়া গ্রামের আমিরুল ইসলাম ও মহেশ্বরচাঁদা গ্রামের আখ চাষী আজগার আলী জানান, বর্তমানে অন্নান্য ফসলের তুলনায় আখের মূল্য একেবারেই কম। মিলটি আখের মূল্য নির্ধারন করেছে মাত্র ৬ টাকা কেজি। উচ্চ মূল্যের এই বাজারে কোন কৃষি উৎপাদিত পণ্যরই এমন মূল্য নেই। তাই বেশির ভাগ কষকের আখ চাষে অনিহা রয়েছে। তারা বলেন, আখের ন্যায্য মূল্য বৃদ্ধি এবং চিনি সমৃদ্ধ আখের জাত নির্ধারণ করে কৃষকদের সহায়তা করতে হবে। তাহলে আখের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
এসব বিষয়ে চিনিকলটির মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) গৌতম কুমার বলেন, এক সময়ে এ অঞ্চলে অনেক চাষিই আখ চাষের সাথে যুক্ত ছিল। এটি এক বছর মেয়াদী আবাদ। বর্তমানে খন্ডকালীন অনেক ফসলের আবাদ হওয়াতে অনেক চাষীই ওই আবাদে ঝুকে পড়েছে। এতেই মিলটি কাচামাল সংকটে পড়ে। তিনি বলেন, নিচু জমিতে উৎপাদিত আখে চিনির রিকোভারী কম হয়। এছাড়াও কিছু অসাধু আখচাষি ওজন বৃদ্ধি করতে জমিতে সেচ ও সার প্রয়োগ করাতেও চিনি উৎপাদন কমে যায়। যে কারনে মিলের উৎপাদন কম হয়ে লোকসানে পড়তে হয়।
বাংলাদেশ চিনিকল শ্রমিক ফেডারেশন সভাপতি ও মোচিক শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি শফিকুর রহমান রিঙ্কু বলেন, চিনিকলটির সাথে এ অঞ্চলের অনেক আখ চাষী ও শ্রমিক কর্মকর্তার জীবন জীবিকা জড়িত। বৃটিশ আমলের যন্ত্রপাতি দিয়ে চালিত এ মিলটি প্রায়ই বন্ধ হয়ে পড়ে। এটি আধুনিকায়ন করা হলে মিলটি তার সাবেক যৌবন ফিরে পাবে। মিলটিকে বাচিয়ে রাখতে সরকারের আশু হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আ.ন.ম জোবায়ের বলেন, মিলের প্রধান কাচামাল উৎপাদনকারী আখচাষীদের আখের মূল্য বৃদ্ধি করতে চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনে আবেদন করা হয়েছে। সেই সাখেই চিনিকলটি লোকসানের কবল থেকে রক্ষা ও লাভজনক পর্ষায়ে নিয়ে যেতে নানা সুপারিশ মন্ত্রনালয়ে অবহিত করা হয়েছে বলে যোগ করেন তিনি।

Ad for sale 100 x 870 Position (2)
Position (2)
Ad for sale 225 x 270 Position (3)
Position (3)
Ad for sale 225 x 270 Position (4)
Position (4)