মণিরামপুরের বাড়িতে শোকের ছায়া

আত্মহত্যা মানতে নারাজ জাবি শিক্ষার্থীর বাবা

এখন সময়: শনিবার, ২০ এপ্রিল , ২০২৪, ০৬:২৬:০০ পিএম

স্পন্দন ডেস্ক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ রফিক-জব্বার হলের আবাসিক ছাত্র অমিত কুমার বিশ্বাসের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে তার গ্রামের বাড়ি যশোরের মণিরামপুর উপজেলার হরিদাসকাঠি ইউনিয়নের পাঁচকাঠিয়া গ্রামের বিশ্বাসপাড়ায়। বুধবার দুপুরে অমিতের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, পাকা বোরো ধান কাটা বন্ধ রেখে তার স্বজনরা বাড়ির প্রধান ফটকে জটলা বেঁধে অমিতের মরদেহ আসার জন্য অপেক্ষা করছেন। অমিতের নানান গুণাবলি নিয়ে কথা বলছিলেন তারা।

শিলা বিশ্বাস নামে অমিতের পঞ্চাশোর্ধ্ব এক কাকিমা বলেন, ‘অমিত ছোটবেলা থেকে ভদ্র আর শান্ত। এলাকায় এলে সবার সঙ্গে দেখা করে। ও আত্মহত্যা করতে পারে না। ওর কিসের অভাব?’

কৃষ্ণ ও পলাশ কান্তি বিশ্বাস নামে দুই চাচাতো ভাইও অমিতের আত্মহত্যার বিষয়টি মানতে পারছেন না। পলাশ বলেন, ‘অমিত ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। জেএসসি ও এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। এরপর খুলনা নৌবাহিনী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়। সে সৃজনশীল মানুষ। সময় পেলে ভালো ছবি আঁকে। আশা করি, সঠিক তদন্তের মাধ্যমে তার মৃত্যুর আসল কারণটি বেরিয়ে আসবে।’

এদিকে আত্মহত্যা-মানতে-নারাজ-জাবি-শিক্ষার্থীর-বাবা অমিতের বাবা অজয় কুমার বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘অমিত ছোটবেলা থেকে শান্ত। কারও সঙ্গে কোনো ঝগড়া বা মারামারি করতে শুনিনি। অবসরে ভালো ছবি আঁকত। এ বছরই অনার্স শেষ হওয়ার কথা ছিল। করোনার কারণে বছরখানেক দেরি হয়ে গেল।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ রফিক-জব্বার হলের আবাসিক ছাত্র অমিত কুমার বিশ্বাসের মৃত্যুর কারণ হিসেবে প্রথমে দুর্ঘটনা ও পরে আত্মহত্যার প্রসঙ্গ এলেও তা মানতে চাইছেন না তার স্বজনরা। তারা বলছেন, অমিত ছোটবেলা থেকে শান্ত, ভদ্র ও সৃজনশীল প্রকৃতির। তাকে কখনও চরম হতাশা বা বিষণ্নতায় ভুগতে দেখেনি ঘনিষ্ঠজনেরা।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিংয়ের শিকার বা হলের কোনো পূর্ব ঘটনার জের ধরে সুপরিকল্পিতভাবে অমিত হত্যাকান্ডের শিকার হয়ে থাকতে পারেন বলে সন্দেহ করছেন নৌবাহিনীতে কর্মরত তার বাবা অজয় কুমার বিশ্বাস।

নিহত অমিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের (২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ) শহীদ রফিক-জব্বার হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। মঙ্গলবার বেলা ২টার দিকে শহীদ রফিক-জাব্বার হলের পাঁচ তলার ছাদ থেকে পড়ে জ্ঞান হারান তিনি। পরে বিকেলে সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

ঘটনার দিন রাত ৯টার দিকে অমিতের বিছানার নিচে একটি চিরকুট পান তার রুমমেটরা। সেখান থেকেই তার আত্মহত্যার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।

চিরকুটে লেখা আছে, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী না। আমার মস্তিষ্কই আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী। আমি নিজেই নিজের শত্রু হয়ে পড়েছি। অজান্তেই নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমি ক্লান্ত। আর না। এবার মুক্তি চাই। প্রিয় মা, বাবা, ছোট বোন- সবাই পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।’

চিরকুটের সঙ্গে অমিতের হাতের লেখার মিল পাওয়া গেছে বলে নিশ্চিত করেছেন তার হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. সোহেল আহমেদসহ তার বাবা অজয় কুমার বিশ্বাসও।

তবে এই চিরকুট অমিতকে দিয়ে জোর করে লিখিয়ে কেউ পূর্বপরিকল্পনা করে তাকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে বলে সন্দেহ করছেন অজয় কুমার বিশ্বাস। ময়নাতদন্ত শেষে ছেলের মরদেহ নিয়ে ঢাকা থেকে যশোরের উদ্দেশে রওনা দেয়ার আগে মুঠোফোনে এমন সন্দেহের কথা জানান অজয়।

অজয় কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘অমিত ছোটবেলা থেকে শান্ত। কারও সঙ্গে কোনো ঝগড়া বা মারামারি করতে শুনিনি। অবসরে ভালো ছবি আঁকত। এ বছরই অনার্স শেষ হওয়ার কথা ছিল। করোনার কারণে বছরখানেক দেরি হয়ে গেল।’

অজয় জানান, ঈদের ছুটি শেষে গত ৭ মে খুলনা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ওঠে অমিত। ঘটনার দিন দুপুরে এক বন্ধুর সঙ্গে হলের বাইরে দুপুরের খাবার খান তিনি। কিন্তু বিকেলে তার এক বন্ধু ফোন দিয়ে বলেন, ‘আঙ্কেল অমিত দুর্ঘটনায় পড়েছে। আপনারা দ্রুত ঢাকায় আসেন।’

রাত ১০টার দিকে ঢাকায় পৌঁছে অজয় জানতে পারেন তার ছেলে অমিত আর নেই। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘পরিবারের একমাত্র ছেলে হিসেবে খুব আদরে ছিল অমিত। আমি চাকরিতে থাকি বলে যা দরকার মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিত সে। এবার ঈদের ছুটিতে বাসায় এসে আমাকে বলল- বাবা এবার তো আমার পড়াশোনা শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিসিএস প্রস্তুতি নেব। হলে গিয়েই কিছু বই কিনব।

‘অমিতের আত্মহত্যা করার তো কোনো কারণ দেখছি না। এবার ঈদে বাড়িতে গিয়েও খুব হাসিখুশিতে ছিল। তার মধ্যে কখনও কোনো চরম হতাশা বা বিষণ্নতায় ভুগতে দেখেনি। কী কারণে এটা হলো বুঝতে পারছি না।’

তবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুর দিকে হলে ওঠার সময় সিনিয়রদের কাছে র‌্যাগিংয়ের শিকার হওয়া কিংবা কারও সঙ্গে কোনো শত্রুতার জের ধরে অমিত হত্যাকাে র শিকার হয়ে থাকতে পারেন সন্দেহ অজয়ের। তিনি বলেন, ‘পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, তাকে ছাদে নিয়ে কেউ ধাক্কা মারতে পারে। এর আগে জোর করে তার হাত দিয়ে এই চিরকুটটি লেখানো হয়েছে বলে ধারণা করছি। অধিকতর তদন্ত করে বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য আমরা ভার্সিটি ও পুলিশ প্রশাসনকে জানিয়েছি।’

বাবা অজয় কুমার বিশ্বাস নৌবাহিনীতে কর্মসূত্রে পরিবার নিয়ে খুলনার বোয়ালখালী উপজেলার খালিশপুর এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে বাস করতেন। অমিতের মা সিমা রাণী বিশ্বাস গৃহিণী। অমিত ছাড়াও টিনা বিশ্বাস নামে অজয় ও সিমা দম্পতির ২০ বছর বয়সী এক মেয়ে রয়েছেন।

গ্রামবাসী জানান, অমিতের মরদেহ গ্রামে পৌঁছালে রাতেই স্থানীয় হাজীরহাট শ্মশানে দাহ করা হবে।